অর্থ আত্মসাত করে শিক্ষার্থীকে হয়রানির অভিযোগ চুয়েট শিক্ষকের বিরুদ্ধে
নারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কুপ্রস্তাব সহ বিভিন্ন ভাবে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত শিক্ষক মো. ইসলাম মিয়া। তিনি পেট্রোলিয়াম এন্ড মাইনিং (পিএমই) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের উপ-পরিচালক।
জানা যায়, তিনি বিভিন্ন সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের কল দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতেন। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতেন। এমনকি বিয়ে করার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখাতেন। তার এ অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হলে ক্লাসে অপমান করা, পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়া এবং এ বিষয়ে কাউকে না জানাতে হুমকি প্রদান করতেন।
এ সকল অভিযোগ এনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট গ্রুপ রিফর্ম চুয়েট ও চুয়েট আড্ডাবাজে পোস্ট করেন পিএমই বিভাগের সাবেক কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে জানতে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিএমই বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ড. ইসলাম মিয়া আমাদের একটি কোর্স নিতেন। কোর্সের প্রথম ক্লাস পরীক্ষা আগে থেকে তিনি আমাকে ফোনে কল দেয়া শুরু করেন। শুরুতে একাডেমিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললেও এক পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন, ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য। উনি বিভিন্ন সময়ে আমাকে ফোন দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন এবং বিয়ে করার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখাতেন। তাই আমি উনার ফোন ধরতে চাইতাম না। কিন্তু তারপরেও উনি আমাকে বারবার কল করে বিরক্ত করতেন। এক পর্যায়ে আমি ফোন কল না উঠানোয় উনি ক্লাসে ও পরীক্ষায় আমাকে বাজেভাবে অপমান করতে শুরু করেন। এ বিষয়ে কাউকে না জানাতে উনি আমাকে হুমকি দিতেন। উনি আমার ব্যাচমেটদের থেকে আমার কারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক আছে কিনা সেসব বিষয়ে জানতে চাইতেন এবং আমাকে ভয় দেখাতেন এমন কিছু থাকলে উনি আমার বাবাকে সব বলে দিবেন। এমনকি উনি বিভাগে সংরক্ষিত আমার ব্যক্তিগত তথ্য থেকে আমার বাবার ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। তখনকার সময়ে উনার এই কার্যকলাপ আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছিলো।আমি অনেক হতাশার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম।
পিএমই বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের আরেক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ইসলাম মিয়া স্যার মাঝে মাঝে রাতে আমাকে ফোন করতেন এবং মেসেজ পাঠাতেন। প্রথমে তিনি ক্লাস লেকচার, ক্লাসে পড়ানো বুঝতে পারছি কিনা এবং অন্যান্য শিক্ষকরা কেমন পড়াচ্ছেন এসব বিষয়ে জানতে চাইতেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই তিনি আমাকে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা শুরু করেন। আমি কারো সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িত আছি কিনা, আমার বিয়ে নিয়ে কী চিন্তাভাবনা ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা শুরু করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ভালো নয় বুঝতে পেরে আমি তাঁর ফোন কল উপেক্ষা করতে শুরু করি, যার দরুন তিনি ক্লাসে আমাকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অপমান করতে থাকেন।
২০১৩ সালের দিকে একদিন তিনি আমাকে বলেন তিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আমাকেও ঐ বিভাগের শিক্ষক বানাবেন যদি আমি তাকে ভবিষ্যতের জীবনসঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করি। এটি শোনার পর আমি হতবাক হয়ে আমার রুমমেটকে বিষয়টি জানাই। পরবর্তীরে রুমমেটের পরামর্শে আমি তখনকার সুফিয়া কামাল হলের সহকারী প্রাধ্যক্ষ পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা আক্তার ম্যামকে বিষয়টি অবহিত করি। এরপর ইসলাম স্যার আমাকে ফোন করা বন্ধ করে দেন। কিন্তু এরপরে তিনি আমাকে পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে কম নম্বর দিতে থাকেন এবং যথারীতি আমার ক্লাসের ও জুনিয়র ব্যাচের অন্যান্য মেয়েদের একই ধরনের হয়রানি করতে শুরু করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি আমার থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন। থিসিস করাকালে পেট্রোবাংলা থেকে সংগ্রহ করা আমার ডাটা এবং থিসিসের ওয়ার্ড ফাইল তাঁর কম্পিউটারে স্থানান্তর করার জন্য আমাকে হুমকি দেন। তিনি আমাকে বলেন আমি যদি ফাইলটি তাকে না দিই, তবে তিনি আমাকে প্রেজেন্টেশন দেয়ার সুযোগ দেবেন না। উনার আচরণে আমি তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। আমি আশা করি চুয়েট প্রশাসন অতি দ্রুত তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এর সত্যতা জানতে পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আয়েশা আক্তারের সাথে বারবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোন সাড়া দেন নি। আজ সকাল ১০টায় পিএমই বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলোচনা সভা আয়োজন করেন।
আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে পিএমই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. সানাউল রাব্বি পাবেল বলেন, আমরা ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের ১০টি দাবির ৩টি দাবি পূরণ করেছি। তবে বাকি দাবি গুলো ও শীগ্রই পূরণ করা হবে। ড. মো. ইসলাম মিয়ার পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ বিষয়ে আমরা শীগ্রই প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিবো।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত মো. ইসলাম মিয়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কোন বক্তব্য দিতে চাচ্ছি না। এরকম অভিযোগ অনাকাঙ্ক্ষিত। আমি এ ধরনের অভিযোগ আশা করিনি। অভিযোগগুলো শুনার পরে আমার মন মানসিকতা এ অবস্থায় নেই যে আমি এ বিষয়ে কোন কথা বলবো। তবে এ বিষয়ে আমাদের বিভাগে আলোচনা হয়েছে।অভিযোগগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আমলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মাফিক যাচাই বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন। অতিদ্রুতই এ বিষয়গুলোয় আমার উত্তর আসবে।
উল্লেখ্য, নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা ছাড়াও ঐ শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ও তুলেছেন পিএমই বিভাগের শিক্ষার্থীরা। গত ২ সেপ্টেম্বর, সোমবার পিএমই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঐ শিক্ষকের পদত্যাগ কে প্রধান দাবি করে ১০ দফা দাবি করেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন ঐ বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
এএজি