দক্ষতা উন্নয়নে বিদেশ যেতে চান ১১০৬ কর্মকর্তা,ব্যয় শত কোটির উপরে
দেশের অর্থনীতিতে চলছে সংকট। নেই রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে গতি। আমদানির চাহিদা মেটাতে নিয়মিত ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ দিনদিন কমছে। এ অবস্থায় ডলার খরচ কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের অহেতুক বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর তাদের ১১০৬ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত ‘অ্যাকসেলারেটিং অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং স্কিলস ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন (এসেট)’ প্রকল্পের অধীনে বিশেষ এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ সংক্রান্ত প্রস্তাবের যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে জুলাই ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ মেয়াদে চার হাজার ২৯৯.৯৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ‘এসেট’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মূল লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের কারিগরি ও স্বাস্থ্য শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার লক্ষ্যে অনেকগুলো কার্যক্রমের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা হাতে-কলমে ও দক্ষতামূলক হওয়ায় শিক্ষকদের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক বৈদেশিক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া এটি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রস্তাবনায় এসব সুপারিশ করা হলেও ডলার সংকটের কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকা অবস্থায় এই বিদেশ ভ্রমণ কতটা যৌক্তিক হবে সেই প্রশ্ন উঠেছে। ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে।
দেশের বাইরে তাদের প্রশিক্ষণের তো দরকার নেই। দেশের মধ্যকার প্রশিক্ষণই যথেষ্ট। এমন ভ্রমণ দেশের অর্থনৈতিক সংকটকালে শুধু অপ্রয়োজনীয়-ই নয়, স্বাভাবিক সময়েও অপ্রয়োজনীয়। প্রশিক্ষণের খুব বেশি দরকার হলে দেশের বাইরে থেকে দুই-তিনজন বিশেষজ্ঞ এনে এক বছর রেখেই প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ।
তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণটি অপরিহার্য হলে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক আনা যেতে পারে। আমার এক বন্ধু (কুমিল্লা বার্ডের সাবেক মহাপরিচালক) বলেছিলেন, তিনি কোরিয়ায় গিয়ে এক প্রশিক্ষককে পান যিনি কুমিল্লার বার্ড (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি) থেকে তার কাছেই প্রশিক্ষণ নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে আমাদের খোঁজ নেওয়া দরকার এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ আছে কি না। না থাকলে আমরা বিদেশ থেকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এনে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারি। অথবা আমরা কিছু লোককে পাঠিয়ে তাদের প্রশিক্ষিত করে দেশে এনে বাকিদের প্রশিক্ষণ দিতে পারি।’
প্রকল্পের মূল লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের কারিগরি ও স্বাস্থ্য শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার লক্ষ্যে অনেকগুলো কার্যক্রমের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা হাতে-কলমে ও দক্ষতামূলক হওয়ায় শিক্ষকদের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক বৈদেশিক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে একটি প্রকল্প থেকে ১১০৬ কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব, আমার কাছে এটি ‘বিলাসী ভ্রমণ’ ছাড়া কিছু নয়। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ক্ষমতাবলে এমন কার্যক্রম হাতে নেন।
‘দেশের বাইরে তাদের প্রশিক্ষণের তো দরকার নেই। দেশের মধ্যকার প্রশিক্ষণই যথেষ্ট। এমন ভ্রমণ দেশের অর্থনৈতিক সংকটকালে শুধু অপ্রয়োজনীয়-ই নয়, স্বাভাবিক সময়েও অপ্রয়োজনীয়। প্রশিক্ষণের খুব বেশি দরকার হলে দেশের বাইরে থেকে দুই-তিনজন বিশেষজ্ঞ এনে এক বছর রেখেই প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। বরং এটি অনেক কাজে লাগবে।’
বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে এসেট প্রকল্পের পরিচালক আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারিভাবে বিদেশ ভ্রমণে এখন একটি নিষেধাজ্ঞা আছে। তবুও আমরা প্রকল্পের কার্যক্রম গতিশীল রাখতে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় সেটি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এখনও সেটি পাস হয়নি।
বিদেশে পাঠানোর পক্ষে প্রস্তাবনায় আরও যা যা বলা হয়েছে
প্রকল্পের ডিপিপি-এর কম্পোনেন্ট ১.১ এ অর্থনৈতিক কোড (৩৬৩২১০১)-এর প্রকল্প অনুদান খাতে ১১৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। প্রকল্প অনুদানপ্রাপ্ত ১১৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে ১১০৬ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণবাবদ ১২০ কোটি টাকার প্রস্তাব পাওয়া গেছে।
প্রকল্প অনুদান খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিওবিতে ৩০ কোটি টাকা এবং আরপিএ খাতে ১৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। প্রকল্পের ডিপিপি-এর কম্পোনেন্ট ৩ (প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, সামাজিক প্রচার-প্রচারণা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন) এর অন্তর্গত অর্থনৈতিক কোড (৩২৩১৩০১)-এর প্রশিক্ষণ খাতে মোট ৬৩.৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিওবিতে আট কোটি টাকা এবং আরপিএ খাতে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ গত বছরের ২ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নের পরিচালিত প্রকল্পসমূহ নিয়ে টিপিআরএম সভার আয়োজন করে। ওই সভায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব উল্লেখ করেন, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পসমূহে বিশেষ বিবেচনায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি-সাপেক্ষে বিদেশে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে।
বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যয় তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বিমান ভাড়া, বিদেশে প্রশিক্ষণ ফি এবং কম্প্রিহেনসিভ অ্যালাউন্সসমূহের মধ্য থেকে প্রকল্পের পক্ষে বিদেশে প্রশিক্ষণ ফি বিশ্ব ব্যাংক সরাসরি প্রশিক্ষণ প্রদানকারী বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানকে প্রেরণ করতে পারে। অন্য দুটি ব্যয়- বিমান ভাড়া ও কম্প্রিহেনসিভ অ্যালাউন্স প্রকল্প দপ্তর থেকে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
এ অবস্থায় এসেট প্রকল্পের আওতায় কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের সম্মতি প্রদানের নিমিত্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সবিনয়ে অনুরোধ করা হলো।
এএজি