Deshdeshantor24com: Bangla news portal

ঢাকা শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

ফুড কনফারেন্স: বাঙালির কপটতা কিংবা রক্তশূল চরিত্রের এন্তেজাম

ফুড কনফারেন্স: বাঙালির কপটতা কিংবা রক্তশূল চরিত্রের এন্তেজাম
গ্রাফিকস দেশ দেশান্তর ২৪.কম

গল্পের প্রবেশদ্বার:

আবুল কালাম শামসুদ্দিনের ভাষ্যে "ব্যঙ্গ ও রঙ্গ, satire ও wit, বাঙালি সাহিত্যে একেবারে নেই একথা বলা চলে না। তবে এদিক দিয়ে সার্থক রচনা নিতান্তই পরিমিত। আমার মনে হয় আবুল মনসুর আহমদ এই মুষ্টিমেয় শিল্পীদের অন্ততম প্রধান। এতটুকু মন্তব্য করেই- আই নাউ ডিক্লেয়ার দি কনফারেন্স ওপেন!"

সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রে বাঙালির আবহমান চারিত্রিক খর্বতা কিংবা দ্বিচারিতা রম্যরচনার সম্ভারে চিহ্নিত করার মুনশিয়ানা বাংলাসাহিত্যে দুর্লভ, সেটি রাজনীতির দিক থেকে হোক কিংবা ধর্মের দিক থেকে, জীবনশিল্পী আবুল মনসুর আহমদ সেই দুর্লভ কাজটিই দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ফুড কনফারেন্স ও আয়না'র মতো অনবদ্য গল্পগ্রন্থগুলোতে; তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ও চারিত্রের ভঙ্গিমা অনায়াসে আঁকড়ে ধরে সময়ের দারুণ কোলাহল, সেটি তৎকালীন যেমন প্রাসঙ্গিক, বর্তমানেও তার খামতি আসেনি একআনা কিংবা সিকি পরিমাণ। "ফুড কনফারেন্স" কেন্দ্রিক বয়ানের মধ্য দিয়ে দেখবো আবুল মনসুর আহমদের পঞ্চাশের মন্বন্তর উপলক্ষ করে তৎকালীন রাজনীতির অন্দরমহলে আমজনতার সাথে নেতৃস্থানীয় লোকেদের ভণিতার মিথস্ক্রিয়া ও কপটতার কালচার; নামগল্প ফুড কনফারেন্স সহ সায়েন্টিফিক বিযিনেস, এ. আই. সি. সি, লঙ্গরখানা, রিলিফ ওয়ার্ক, গ্রো মোর ফুড, মিছিল, জমিদারি উচ্ছেদ ও জনসেবা য়ুনিভার্সিটি নামে সর্বমোট নয়টি গল্পে সাজানো হয়েছে "ফুড কনফারেন্স"; যেখানে আলাপের দেহাবয়ব একরৈখিক হলেও তথাপি আবহমান বাংলার সরল-স্বভাবী এবং অভাবী তথা প্রান্তিক মানুষের চলার পথ ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রজীবনে নানাবিধ উপায়ে ভন্ডুল কিংবা কণ্টকাকীর্ণ করার অপ-রাজনীতি যারা করেছিলেন, রাগঢাক না করে খুব সহজেই তাদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন রাজনীতিজ্ঞ সাহিত্যিক আবুল মনসুর। 

গল্পের বৈশিষ্ট্য:

ক. ফুড কনফারেন্স - রক্তশূল;

খ. সায়েন্টিফিক বিযিনেস - দূর্নীতিগ্রস্থ;

গ. এ. আই. সি. সি - শোকব্যবসায়;

ঘ. লঙ্গরখানা - টেন্ডারবাজি;

ঙ. রিলিফ ওয়ার্ক - শ্রেণীবৈষম্য;

চ. গ্রো মোর ফুড - টোটালিটারিয়ান চরিত্র;

ছ. মিছিল - চোরাকারবারি;

জ. জমিদারি উচ্ছেদ - ক্ষমতার প্রতারণা;

য. জনসেবা য়ুনিভার্সিটি - বেকারের সেবা প্রতারণা;

গল্পের দেহাবয়ব পাঠ:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভীষণ খাদ্যাভাবের ফলে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের সৃষ্ট কৃত্রিম খাদ্য-সংকটে বাঙলায় দেখা দেয় এক প্রলয়ঙ্করী দুর্ভিক্ষ, যার ফলস্বরূপ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কঙ্কালসার হয়ে রাস্তাঘাটে নগ্নাবস্থায় দিনাতিপাত করতে থাকে, ভদ্রসমাজের চোখে তা অশ্লীল বোধ হয়, ফলে তারা ফুড কনফারেন্সের আয়োজন করে, এবং উক্ত কনফারেন্সে তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি অর্জনে এতোটাই মরিয়া হয় যে, যাদের জন্যে আয়োজন, তারা মরে শহর সাফ হয়ে যাবার পর কনফারেন্সের ইতি ঘটে; ফলে তারা ভুখাদের খাদ্যসংকটের চিন্তা থেকে মুক্ত হয়; অর্থাৎ, পুঁজিবাদের বিকাশে ধনিদের টিকে থাকবার অধিকার থাকলেও গরিবের পাছায় ত্যানা না জুটলেও চলবে, খাদ্য পাক কিংবা না পাক, নেতাদের তা মাথায় থাকবার কথা নয়। পশুরা জিন্দা থাকলেও মানুষরা মরে ভূত হয়ে যাক, কারো কিছু যায় আসে না। ফলত ফুড কনফারেন্সের চরিত্র বলে ওঠে "জানোয়ারে বাঙলা জিন্দাবাদ, মানুষে বাঙলা মূর্দাবাদ।" সমাজ বৈতরণির প্রেক্ষাপটে "সায়েন্টিফিক বিযিনেস" গল্পে চাকরি লাভে ব্যর্থ বাঙালি ব্যবসার নামে ঝুঁকিহীন, পুঁজিহীন কালোবাজারি ও দুর্নিতীর মাধ্যমে একটা জনগোষ্ঠীকে হাবিয়া দোযখে সিলগালা করার দৃশ্য নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার আবুল মনসুর আহমদ; যেখানে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে ভূখন্ডের সর্বত্র বাঙালিদের সাফ করার মাধ্যমে বাঙালি-চরিত্রের অধঃপতনের দিকটি উন্মোচন করেছেন। "এ. আই. সি. সি" গল্পে চিত্রায়িত করেছেন পূর্বপুরুষদের নাম বেচে খাওয়ার মতো জঘন্য অথচ চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ বনে যাওয়া প্রপঞ্চকে হাতিয়ার করে নানান সংঘ কিংবা সংগঠন, অঙ্গ-সংগঠন গড়ে তুলে নিজেদের ফায়দা লুটার বন্দোবস্ত টেকসই করার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে আপন অপশক্তির সঞ্চার। দুর্ভিক্ষকে হাতিয়ার করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া নেতাদের অশনিসম্পাতের অনবদ্য আখ্যান "লঙ্গরখানা;" যেখানে অনাহারে দিনাতিপাত করা মানুষদের খাওয়ানোর নাম করে ব্যানার টাঙিয়ে তাদের জীবন নিয়ে জুয়াচুরি কিংবা মিথ্যার বেসাতি সাজানোর মূলহোতাদের গ্রেফতার করেছেন আবুল মনসুর তাঁর কলমের কালির শিকলে; নদীমাতৃক বাঙলার চিরাচরিত চিত্র- বন্যা; দেশব্যাপী যখন জনসাধারণ বন্যাদুর্গত-দুর্দশাগ্রস্থ, মৌলিক অধিকার বঞ্চিত; তখন রিলিফ কমিটির পক্ষ থেকে ভদ্রলোক নামের এলিটশ্রেণীদের বিতরণ করা হচ্ছে বন্যাকবলিত মানুষের খাবারাদি; তেলা মাথায় তেল দেয়া স্বভাব বলে কথা। "রিলিফ ওয়ার্ক" গল্পে উঠে এসেছে এমন মানবেতর সময়ের শ্রেণীবৈষম্যের চিত্র কিংবা চাটুকারিতার ক্যু নমুনা; যা সমাজপতিদের পাশবিকতার চরম মতদ্বৈধতার নজির এবং আমজনতার কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার গল্প। "গ্রো মোর ফুড" গল্পে গল্পকার দেখিয়েছেন কিভাবে গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপের ফলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার কিংবা ক্ষমতার আয়ু বাড়াবার জন্যে যা করা দরকার, তা-তা করবার টোটালিটারিয়ান আচরণের প্রবণতা; এছাড়া উঠে এসেছে জনগণের চোখে অসার ধোঁয়াশা ছড়িয়ে নানাবিধ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে রাষ্ট্রীয় অর্থ তসরুপের প্রসঙ্গ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বোত্তর কালে পণ্য সরবরাহের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে কুটচাল চালানো ব্যবসায়ীমহল এবং পোশাকী আমলাদের স্বরূপ খুলে দিয়েছেন আবুল মনসুর তাঁর "মিছিল" গল্পে; এতে আরো লক্ষ্য করা যায় অপ্রাপ্তির বেদনা হ্রাসে ব্যর্থদের পুলিশকে যুদ্ধবিরোধী ফিফথ কলাম ব্যবসায়ীদের মিছিলের খবর দেওয়ার মধ্য দিয়ে আপন ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে হলেও অপরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা করার অসাধু চিত্র। "জমিদারি উচ্ছেদ" গল্পে চিত্রায়িত হয়েছে আরেক প্রতারণার গল্প, যাতে খাঁজনা পরিশোধের লাঞ্চনা থেকে বাঁচানোর নাম করে জমিদারি উচ্ছেদ করবার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমজনতার সাথে প্রতারণা করে নব্যজমিদার বনে যাওয়া মুনশীজির অবিনাশী কিংবা কপটিয় চরিত্র। নির্বাচনে জেতার পর উন্নয়নের সাগরে ভাসানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া সমাজের এমন মুনশীজি নামের প্রতারকদের খোলনলচে জনসম্মুখে হাজির করেছেন আবুল মনসুর তাঁর এই গল্পের মধ্য দিয়ে। জনসাধারণের বিশ্বাসকে পুঁজি করে জনসেবার নামে আত্মসেবা কিংবা আত্মউন্নয়নে সামিল থেকে সমাজের মোড়ল বনে যাবার চিত্র অঙ্কণ করেছেন "জনসেবা য়ুনিভার্সিটি" গল্পে। গল্পকার এই গল্পে বিদ্যায়তনিক স্তরানুযায়ী ক্ষমতার স্তরের কাঠামো তৈরীতে দেখিয়েছেন মুনশিয়ানা; যেখানে ইয়াকুব পড়াশোনা শেষে চাকরি না পেয়ে জনসাধারণের বিশ্বাস-ভরসার চোখে গুড়ে বালি ঢেলে সমাজের চোখে বনেছেন শ্রদ্ধার পাত্র- সমাজসেবক। সমাজে ইয়াকুবের মতো এমন জনসেবকদের দুষ্টচক্রের বিষবাষ্পে হেরে যায় সরল স্বভাবী মানুষের বিশ্বাস আর জিতে যায় তাদের সেবক হবার বন্দোবস্ত তৈরির দুষ্টবুদ্ধি।

গল্পের পাঠ-ফোঁড়ন:

বাঙালির জীবনাচরণ ও চালচিত্রের এক উৎকৃষ্ট কিংবা প্রকৃষ্ট এন্তেজাম "ফুড কনফারেন্স", যার ভেতর দিয়ে আবুল মনসুর আহমদ দেখানোর চেষ্টা করেছেন বাঙালি সমাজের স্বভাবসুলভ চরিত্রের চিরকালীন গায়রত। খাদ্য, ক্ষমতা কিংবা প্রতারণার রাজনীতির মধু পান করার যে চক্র, তার মুখোশ উন্মোচন করার মাধ্যমে নিত্যদিনের ঘটনা পরিক্রমায় প্রত্যক্ষ করা বর্তমান, অতীত এবং ভবিষ্যতের দিক নির্ণয়ের ফলে যেকোনো পাঠকই নিজেদের জীবনকে যাপন করার ক্ষেত্রে প্রত্যহ যে ঘটনাবলী অবলোকন করেন তার সাথে এই গ্রন্থের যে মিল, তা পাঠককে ভাবিত করবে নিঃসন্দেহে। কোনো রচনার প্রাসঙ্গিকতা কিংবা উপযোগিতা নীরিক্ষার মানদণ্ড হিসেবে সময় ও কাল কতোটুকু আঁকড়ে ধরতে পারে তার চরিত্রের অন্তঃদৃষ্টির যষ্টিধারী পথের আলো, অথবা অন্ধকারের কালোছায়া কতোখানি অবরুদ্ধ করতে পারে সমাজ-সমকালকে, তার চিত্রধারণ করতে পারে যে রচনা, তেমন রচনাই শতবছরেও মানুষের হৃদয়ে অমর থেকে- সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের রক্তশূল কিংবা দূর্নীতিগ্রস্থ সমাজপতিদের শোক-ব্যবসায়ী কিংবা টেন্ডারবাজ বনে যাওয়া, এবং সমাজে একটি কৃত্রিম সংকট তৈরীর মাধ্যমে শ্রেণীবৈষম্যের উদ্রেক ঘটানোর মাধ্যমে মনের অজান্তে নিজেদের মানুষরূপী পশুত্যের টোটালিটারিয়ান চরিত্রের আমদানি করা, যার মাধ্যমে চোরাকারবারি, কালোবাজারিসহ ক্ষমতার মসনদ পর্যন্ত পৌঁছানোর উপায়-উপকরণ হিশেবে নিজেদেরকে সমাজে জন ও গণমানুষের সেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার রম্য অথচ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাবলীর এন্তেজাম এই ফুড কনফারেন্স। পরিশেষে ইতি টানি কালোত্তীর্ণ এই গ্রন্থটির প্রকাশকের ভাষ্যে, "সাম্রাজ্যবাদী সামন্তবাদী শোষণের ফলে দুনিয়ার শষ্যভান্ডার সুজলা-সুফলা বাংলা ১৩৫০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক লোক-ক্ষয়ী আকালের শিকার হইয়াছিল। বাঙলার দুইটি শ্রেষ্ঠ প্রতিভা এই আকালের বাস্তব ছবি আঁকিয়াছিলেনঃ শিল্পী জয়নুল আবেদীন আঁকিয়াছিলেন ব্রাশ ও তুলিতে আর আবুল মনসুর আঁকিয়াছিলেন নকশার কলমে। তাঁর অমর সৃষ্টি ফুড কনফারেন্সই বেদনার তীব্র কষাঘাতে ফুটে ওঠা সেই নকশা। এই নকশার দিকে নজর দিয়াই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় লিখিয়াছিলেনঃ 'আয়না' লিখিয়া আবুল মনসুর প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন আর 'ফুড কনফারেন্স' লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।"

লিখেছেন- শাহাদাত সুফল
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

কেএ