ঘুরে আসুন বনলতার নাটোরের রাজবাড়ীতে
বনলতার শহর, রাজবাড়ীর শহর, ইতিহাস-ঐতিহ্যের শহর নাটোর। অসাধারণ ব্যক্তিত্বে রানী ভবানীর স্মৃতি বাংলার মানুষের কাছে এখনও উজ্জ্বল। নবাবি আমলে গড়ে ওঠা নাটোর রাজ্যের মহারানী ছিলেন অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী। তিনি ছিলেন নাটোর রাজবংশের উজ্জ্বলতম চরিত্র। রানী ভবানী রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও মালদহ জেলা শাসন করতেন।
দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক এখানে দেখতে আসেন রানী ভবানীর বাড়ি। নাটোর রাজবাড়িখ্যাত এ বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখার পাশাপাশি রানী ভবানীর বর্ণাঢ্য ইতিহাস জেনে মুগ্ধ হন পর্যটকরা।
নাটোর রাজবাড়ির ইতিহাস-ঐতিহ্য: অর্ধবঙ্গেশ্বরীখ্যাত রানী ভবানীর এ রাজবাড়িটি ১৭০৬ সাল থেকে ১৭১০ সালের মধ্যে রাজা রামজীবন স্থাপন করেন। ১৭৩৪ সালে রাজা রামজীবন মারা যাওয়ার পর তার দত্তক নেওয়া ছেলে রামকান্ত নাটোরের রাজা হন। ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রানী ভবানীর ওপর রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন নবাব আলীবর্দী খাঁ। রানী ভবানী দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পায়। তার আওতায় ছিল রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও মালদহ জেলা।
১৮০২ সালে রানী ভবানীর মৃত্যুর পর তার দত্তক ছেলে রামকৃষ্ণ রাজ্যভার গ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিশাল এ জমিদারি তার দুই ছেলে বিশ্বনাথ ও শিবনাথ রায়ের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে বড় তরফ ও ছোট তরফ নামে দুটি আলাদা জমিদারির উত্থান ঘটে। ছোট ছেলে শিবনাথের অংশের নাম হয় ছোট তরফ। নাটোর রাজবংশের ছোট তরফের শেষ রাজা ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ। তিনি ১৮৯৭ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এই ছোট তরফের জমিদার ছিলেন।
রানী ভাবনীর রাজ্যের আয়তন: নাটোরের ইতিহাস গবেষক খালিদ-বিন-জালাল বলেন, অবিভক্ত বাংলার মোট আয়তন ছিল ৭৭ হাজার ৫২১ বর্গমাইল। এর মধ্যে রানী ভবানীর রাজ্য ছিল ১২ হাজার ৯৯৯ বর্গমাইল। তবে দুই বাংলার বড় অংশ তিনি শাসন করতেন। রানী ভবানী দানশীল ছিলেন বলে দাবি করে এ ইতিহাস গবেষক বলেন, তিনি তার রাজ্যে প্রজাদের মধ্যে এক লাখ বিঘা জমি বিনা খাজনায় দান করেছেন।
খালিদ-বিন-জালালের মতে, বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর রানী ভবানীর রাজ্য ও ক্ষমতা কমতে থাকে। রানী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত মূল ভবনটিই ‘রানী ভবানীর রাজবাড়ি’ অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী নাটোর রাজবাড়ি। রানী ভবানীর মূল ভবনটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকলেও বড় তরফ ও ছোট তরফ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কী কী আছে নাটোর রাজবাড়িতে: এতে ছোট-বড় ৮টি ভবন, দুটি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতাধীন প্রবেশমুখে রয়েছে বিশাল একটি পুকুর। সেই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাট দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। জলটুঙ্গি, তারকেশ্বর, গোপীনাথ, আনন্দ ও মহাল রাজবাড়ির ছোট পুকুরগুলোর নাম। রাজবাড়ি ঘিরে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। জানা যায়, এ বেড়চৌকি রাজবাড়িকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করত।
নাটোর রাজপরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন নাটোরেই স্থাপন করেছিলেন তাঁর প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং সেই সাথে নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দিঘি, মন্দির এবং ফল ও ফুলের বাগান। ভগ্ন প্রাসাদের বিচ্ছিন্ন সাতটি ব্লককে বেষ্টনকারী কাদা ও আগাছা আচ্ছাদিত দিঘি সেই পরিখার চিহ্ন বহন করছে। পরবর্তীকালে রানী ভবানী কমপ্লেক্সটির উন্নয়নে ও বৃদ্ধিতে যথেষ্ট অবদান রাখেন।
সাতটি ব্লকের মধ্যে মাত্র চারটিকে মোটামুটি সংস্কার করে বর্তমানে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অফিস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। আর বাকিগুলি আকারহীন বিচ্ছিন্ন কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ। একতলা বিশিষ্ট উত্তর ব্লকটি বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে ডেপুটি কমিশনারের অফিস হিসেবে। এর ঠিক সামনে অর্থাৎ দক্ষিণে রয়েছে একটি বেশ বড় উন্মুক্ত লন। এ লনের দক্ষিণ ও পশ্চিমে রয়েছে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের আকৃতিতে দুটি ব্লক, যেগুলির পূর্ব পার্শ্বে রয়েছে ফাঁকা জায়গা। উত্তরের প্রধান ব্লকটির সম্মুখভাগ প্রায় ৩০.৪৮ মিটার বিশিষ্ট। এর ঠিক মাঝামাঝিতে রয়েছে একটি লক্ষণীয়ভাবে অভিক্ষিপ্ত পোর্চ, আর দুপ্রান্তে রয়েছে সামান্য বর্ধিত দুটি ‘বে’ এবং এদের উপরে আছে ত্রিভুজাকৃতির পেডিমেন্ট।
জাঁকালো কেন্দ্রীয় পোর্চ ও সামনের বারান্দার ভার বহন করছে সারিবদ্ধভাবে স্থাপিত সেমি-কোরেনথিয়ান রীতিতে তৈরি স্তম্ভ ও ক্লাসিক্যাল রোমান ফ্যাশনে ভাগ ভাগ করে নির্মিত বিচ্ছিন্ন খিলানসমূহ। এ ব্লকে রয়েছে ঠিক কেন্দ্রে স্থাপিত একটি বিশাল অভ্যর্থনা হল ও একে ঘিরে এগারোটি বৃহৎ কক্ষ। কেন্দ্রীয় হলটির (১৮.২৯ মি × ৯.১৪ মি) সিলিং ৯.১৪ মিটার উঁচু এবং হলে আলো প্রবেশ করার জন্য রয়েছে রঙিন কাঁচের গ্লাসে নির্মিত দেওয়ালের উপরের দিকে স্থাপিত ছাদসংলগ্ন ১৮টি জানালা। কিছু কিছু স্তম্ভের শীর্ষে শোভাবর্ধক হিসেবে রয়েছে ক্লাসিক্যাল নগ্ন নারী ভাস্কর্য।
পশ্চিমের ৬০.৯৬ মিটার দীর্ঘ এক তলা ব্লকটিও কেন্দ্রে খিলান বিশিষ্ট অভিক্ষিপ্ত ‘বে’ সমৃদ্ধ। সামনের খোলা বারান্দাটির সমস্তটি জুড়ে রয়েছে সারিবদ্ধ ডোরিক রীতির স্তম্ভ। ব্লকটির পেছনে রয়েছে একটি নাট-মন্ডপ (নাচ ঘর) এবং তারও পেছনে আরও পশ্চিমে আছে একটি কৃষ্ণ মন্দির। এ পারিবারিক মন্দিরটি প্রায় ১৫.২৪ মিটার প্রশস্ত। মন্দিরটিতে রয়েছে ডাবল কোরিনথিয়ান স্তম্ভের সারি ও পেছনে রয়েছে ৩.০৫ মিটার প্রশস্ত বারান্দা। এ ব্লকের ঠিক সমকোণে নির্মিত হয়েছে উত্তরমুখী আর একটি এক তলা বিল্ডিং যার সম্মুখভাগ ৪৫.৭২ মিটার প্রশস্ত। অভিক্ষিপ্ত কেন্দ্রীয় পোর্চ ও তদ্সংলগ্ন বারান্দা এবং এগুলির পেছনে রয়েছে সারিবদ্ধ কক্ষ। ব্লকটির পাশেই রয়েছে একটি আগাছাচ্ছন্ন দিঘি। ব্লকটির পশ্চাৎ ভাগ প্লাস্টারের সাহায্যে তৈরি নকশায় অলংকৃত। বর্তমানে এ ভবন পুলিশের সুপারিনটেন্ডেন্ট-এর অফিস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঐ একই দিঘির পাশেই দৈব্যক্রমে টিকে আছে আরও দুটি ভবন। এদের মধ্যে ছোটটি ১৫.২৪ মিটার চওড়া। এর বারান্দায় রয়েছে সারিবদ্ধ ডোরিক রীতির জোড়া স্তম্ভ। বড়টি ৩০.৪৮ মিটার প্রশস্ত এবং এর বারান্দাটি দাঁড়িয়ে আছে সেমি-কোরিনথিয়ান স্তম্ভের উপর। দুটি ভবনই এখন ঘনঝোপ ও ধ্বংসাবশেষে ঢাকা।
তবে পরিত্যক্ত দিঘিটির পশ্চিম পাড়ে চিত্রের ন্যায় উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ছোট-তরফ ভবনের মূল ব্লকটি একটি মনোরম ভবন যা বর্তমানে জেলা জজ কোর্ট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। ২১.৩৪ মিটার ফাসাদের ভবনটিতে রয়েছে তিনটি খিলানবিশিষ্ট একটি অভিক্ষিপ্ত বর্ধিত বারান্দা। ভবন কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশাল অভ্যর্থনা হল যা পার্শতবর্তী অন্যান্য অংশ থেকে উঁচু। এর শীর্ষে রয়েছে পিরামিডাকৃতির ছাদ এবং আলো প্রবেশের জন্য ছাদসংলগ্ন জানালা। পোর্চের প্যারাপেটকে অলংকৃত করা হয়েছে প্লাস্টারের সাহায্যে ফুলেল লতাপাতা ও নব-যুগীয় ভাস্কর্যের মিশেলে ফ্রিজ নকশায়। ভবনের দুপ্রান্তে রয়েছে দুটি ছোট অভিক্ষেপের বর্ধিত ‘বে’। এগুলি আবার অলংকৃত হয়েছে দুজোড়া কোরিনথিয়ান স্তম্ভ ও উপরে দেওয়ালের ত্রিভুজাকৃতি অংশ দ্বারা। এ ভবনে রয়েছে দুটি বিশাল হল ঘরসহ মোট পনেরোটি কক্ষ। হল ঘরগুলি একটির পর আর একটি স্থাপিত। ভবনের একেবারে পেছনের দিকে রয়েছে একটি ব্যালকনি, যা একটি পরিখার কোল ঘেঁষে অবস্থিত।
রাজবাড়ির মন্দির ও স্থাপনায় শৈল্পিক কাজ: নাটোর রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে আটটি মন্দির রয়েছে, আছে এক বিশাল শিবমন্দিরও। এখানে এখনও রীতি মেনে নিয়মিত পূজা হয়। দৃষ্টিনন্দন মন্দিরের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। মন্দিরকে ঘিরে আছে একটি শিবমূর্তি, ফণা তোলা সাপের মূর্তি, একজন বাউলের মূর্তিসহ নানারকম শৈল্পিক কাজ। মন্দিরটির দেয়ালজুড়ে টেরাকোটার শিল্পকর্ম। হানি কুইন নামে একটা রেস্ট হাউস, একটি বৈঠকখানা, মালখানা, রানী ভবানীর উন্মুক্ত মঞ্চ। পুরো রাজবাড়ি ঘিরে রয়েছে হরেক রকমের বিশাল বিশাল গাছ। রয়েছে নানা জাতের ফুলগাছ। পাশেই আনন্দ ভবন নামে একটি কমিউনিটি সেন্টার।
যেভাবে যাবেন নাটোর রাজবাড়ি: রানী ভবানীর রাজবাড়িটি দেখতে নাটোরে বাস ও ট্রেনে আসা যায়। ট্রেনে নাটোর স্টেশনে এসে এখান থেকে অটো ও রিকশা রিজার্ভ নিলে ৪০-৫০ টাকা ভাড়া লাগবে। নাটোরের উত্তরের জেলা বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে এলে নামতে হবে মাদরাসা মোড়। এ মোড় থেকে রিকশা রিজার্ভ নিলে ২০-২৫ টাকা ভাড়া নেবে।
যেখানে থাকবেন: নাটোরে কেউ থাকতে চাইলে সদর থানার সামনে হোটেল আর পি এবং চকরামপুর এলাকায় হোটেল ভিআইপি রয়েছে। ডাবল বেডের নন এসি কক্ষের ভাড়া ৫শ থেকে ৭শ টাকা, আর এসি কক্ষগুলো ৮শ থেকে ১২শ টাকা ভাড়া লাগবে।
কেএ