পাহাড়ে পাহাড়ে জুমের সোনালী ধান কাটার উৎসব
জুম থেকে ফসল তুলতে জুম চাষিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে জুমের সোনালী ধানকাটার উৎসব। কাজের ফাঁকে বিশ্রামের জন্য পাহাড়ে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী জুমঘর। বছরের এ সময়ে পাহাড়ে জুমের সোনালি ধান জুম চাষিদের এনে দিয়েছে ব্যস্ততা। তবে এ বছর ফলন ভালো না হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেক জুম চাষি।
বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বাঙালিসহ ১২টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের সামাজিক ভাষা ও সংস্কৃতিগত রয়েছে ভিন্নতা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎস জুম চাষ। এটি পাহাড়িদের আদি পেশা। জুমের পাকা ধানের চাল দিয়ে চলে সারা বছরের খাদ্য। উচুঁ পাহাড়ের ঢালু ভুমিতে ধানসহ হলুদ, মারফা, মরিচ, ভুট্টা ও তিলসহ প্রায় ৩০-৩৫ জাতের সবজির চাষাবাদ করে থাকেন।
এপ্রিলে মাসজুড়ে চলে জুমের জায়গা সম্পূর্ণ প্রস্ততকরণের কাজ আর কাঙ্খিত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা। বৃষ্টি হলে জুমে ধানসহ বিভিন্ন ফসল বপন শুরু করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধান বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে। আর যারা একটু দেরীতে বপন করেন তাদের ধান দেরীতেই পাকে। প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই করা ও শুকানোর প্রক্রিয়া চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূল ঘরে ধান স্থানান্তর করার পর ফেব্রুয়ারি-মার্চে চলে ঘরে ঘরে জুমের নবান্ন উৎসব।
জুম চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বান্দরবানের মোট সাত উপজেলায় বসবাসকারী পাহাড়ি পরিবারগুলো সবাই কম-বশি জুম চাষ করেন। মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমি, লুসাই, পাংখো, বম, চাকসহ ১১টি সম্প্রদায়ের অধিকাংশই জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। জুমের উৎপাদিত ধান থেকে পুরো বছরের খাদ্যের যোগান মজুদ করেন তারা। তবে এ বছর ভারী বর্ষণ ও পাহাড় ধসে অনেক জুমক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।
জুম চাষিরা জানিয়েছেন, এবারে জেলা ভারী বৃষ্টির ফলে কিছু জুমের ধান পাহাড়ের পানির ঢলে ভেসে গেছে। অনেক স্থানে চাষ করা জুম পাহাড় ধ্বসে পড়ে গেছে। এখনো জুমের ধান মাটিতে শুয়ে গেছে। সেসব ধান মাটি সাথে মিশে নষ্ট হয়ে গেছে।
বান্দরবান কৃষি বিভাগ তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৮ হাজার ৩ শত ৭৮ হেক্টর জমিতে জুমের ধান আবাদ হয়েছিলো ২০ হাজার ২শত মেট্রিকটন। চলতি ২৩-২৪ বছরে ৭ হাজার ৯শত ৩৩ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৮৭ মেট্রিকটন। যা গত বছরে তুলনায় এবার ২ মেট্রিকটন ফলন কম হয়েছে। তাছাড়া জেলায় ভারী বৃষ্টিরপাতের কারণে কিছু কিছু স্থানে জুমের পাহাড় ধসে গেছে। ফলে ফলন কম হয়েছে।
থানচি উপজেলা বলিপাড়া এলাকায় দিনতে ম্রো পাড়ার বাসিন্দা দৈ লাং ম্রো স্বপরিবার ও প্রতিবেশীদের নিয়ে জুমের পাকা ধান কাটছেন। তিনি বলেন, পরিবারের বাইরের সদস্যরা আমার শ্রমিক নয়, তারা সবাই প্রতিবেশী আগাম শ্রম দিতে এসেছেন। তার জুম কাটা শেষ হলে অন্যদের জুমেও সেভাবে তাদেরকে সহযোগীতা করতে হবে। সেটা মারমা ভাষায় লাকসা, ম্রো ভাষায় তৈপো ক্রোতমে, চাকমারা বলে মালেয়া অর্থাৎ এটা শ্রমের বিনিময়ে শ্রম, একে অপরকে দলবেঁধে সহযোগীতা করা।
জুমের ধান কাটতে কাটতে তিনি আরো বলেন, এবছর প্রায় ৫শ শতক ধানের জুম করতে পেরেছেন। তবে এবছর জুমের ধান তেমন ভালো হয়নি। কারণ যখন বৃষ্টির দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি, আর যখন রোদ দরকার তখন বৃষ্টি হয়েছে। সময়মতো রোদ-বৃষ্টি হলে জুমের ধান ভালো হতো। এখন সময় মতো কিছুই হয়না, প্রকৃতিও উল্টো হয়ে গেছে। সেজন্য জুম থেকে ধান যা পাবেন, তা দিয়ে কোনমতে বছর যাবে।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক এম,এম শাহ্ নেয়াজ জানান, এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে জুমিয়ারা যেসব জুমে বীজ বপন করতে পেরেছে সেসব ধান ভালো হয়েছে। এপ্রিল শেষের দিকে যারা বীজ বপন করেছে সেসব জুমের ধান কিছু বিলম্ব হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, প্রতিটি পাহাড়ের এখন জুমের ধান কাটার উৎসব শুরু হয়েছে। ৮০ শতাংশ স্থানীয় জাতের আবাদ করা ধানগুলো অনেক স্থানে কাঁটা শুরু হয়েছে। তাছাড়া ফলন তেমন খারাপ হয় নাই। যেহেতু জুমের ফসল নিমজ্জিত হয় নাই। তাই জুমের ফলন মোটামুটি ঠিক রয়েছে।
এমআইপি