বাজার ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের অভাব
অনেক কারণ একসঙ্গে মিলে মূল্যস্ফীতিকে আজকের এ অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। যখন মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করল, তখন যথেষ্ট নীতি পদক্ষেপের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল না। নীতি পদক্ষেপের যে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, তা অনুধাবনেও যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। ২০২০ কিংবা ২০২১ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতার শুরুর দিকে বলার মতো তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখিনি। শেষ পর্যন্ত চরম অবস্থায় এসে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেগুলো সব ক্ষেত্রে সঠিক ছিল না।
যেমন– উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল নীতি সাংঘর্ষিক।
ঋণ ও আমানতে বেঁধে দেওয়া সুদের হার এক পর্যায়ে এসে উঠিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু তত দিনে অনেক বেশি দেরি হয়ে যায়। তারপরও সুদের হারে মাত্র ১ শতাংশের মতো পরিবর্তন আসে। অর্থনীতির মাপকাঠিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়াতে হয় এবং সরকারি ব্যয় কমাতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাহত হয় কিনা, সে ভাবনা থেকে এ রকম ভারসাম্যের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। এখানে যথেষ্ট বিচক্ষণতা দেখানো যায়নি। মূল্যস্ফীতির এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এতে বাজারে অর্থ সরবরাহ বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দেয়। অথচ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের কারণে ঢালাও আমদানি নিয়ন্ত্রণের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার অন্যতম কারণ। এতে বাজারে ভুল বার্তা গেছে। আমদানি করা হবে না বা যাবে না– এ রকম পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে ইচ্ছামতো। নিত্যপণ্যের আমদানিতে সহনীয় শুল্ক এবং দ্রুত আমদানির সুযোগ রাখা হলে ব্যবসায়ীরা এত কারসাজির সুযোগ পেতেন না। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় খুবই প্রণিধানযোগ্য, আমাদের বাজারের আচরণ নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অর্থাৎ বাজার ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের অভাব সুস্পষ্ট। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাজার অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। পণ্য পরিবহনে বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, যা পণ্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিভিন্ন দেশে পণ্যে দর বেড়ে যাওয়ার প্রবণতায় প্রতিযোগিতা কমিশন বাজার বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেয়। আমাদের এখানে প্রতিযোগিতা কমিশন আছে বটে, তবে কোনো কার্যক্রম বা তৎপরতা আছে বলে মনে হয় না।
লাগামহীন মূল্যস্ফীতির আরও একটা বড় কারণ হচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক পতন। গত দুই বছরে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ দর কমেছে। বিশেষ করে আমদানি পণ্যের দর বাড়িয়েছে টাকার দর পতন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি যে মূল্যস্ফীতির অনেক বড় কারণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দর কমে আসার পরও দেশে দর সমন্বয় করা হয়নি। এখানে একবার বাড়লে আর কমানোর খুব নজির নেই। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম রাজস্ব আহরণও মূল্যস্ফীতির একটি বড় কারণ। করযোগ্য অনেকেই করের আওতায় নেই। যে পরিমাণ কর দেওয়ার কথা, সে পরিমাণ অনেকেই দেন না। কর কঠামোতে সমস্যা আছে। রাজস্বে স্বাচ্ছন্দ্য না থাকার কারণে সরকারের পক্ষে সহায়ক অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়নি।
বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং দেশে মূল্যস্ফীতির চাপসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে বড় ব্যয়ের মেগা প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করার প্রয়োজন ছিল। এ সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া কিংবা গতি ধীর রাখা যেত। সে রকম হলে রাজস্বে স্বাচ্ছন্দ্য আসত। অর্থাৎ সরকারি ব্যয় হ্রাসের প্রক্রিয়া হিসেবে এ পর্যালোচনা করা যেত। তবে আমি এখানেও ঢালাওভাবে সব ব্যয় কমানোর কথা বলছি না। যেমন– মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমনে গরিব মানুষের জন্য নগদ সহায়তা আরও বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, যা শ্রীলঙ্কার মতো একটি সংকটাপন্ন দেশও করেছে। শ্রীলঙ্কার সরকার দেশটির ২৫ লাখ গরিব মানুষকে নগদ সহায়তা দিয়েছে। এর ফলে সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ে আর হাহাকার দেখা যায়নি। আমি মনে করি, মোটা দাগের এসব বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলে দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আমরাও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে এ দেশের জনগণকে কিছুটা ভালো রাখা সম্ভব।
বাজার ব্যবস্থাপনা সুশাসন ড. আব্দুর রাজ্জাক
গবেষণা পরিচালক, পিআরআই ও চেয়ারম্যান র্যাপিড বাংলাদেশ
এমআইপি