Deshdeshantor24com: Bangla news portal

ঢাকা শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪

গল্প

আত্মার স্পন্দন ধ্বনি

 আত্মার স্পন্দন ধ্বনি

মানুষ মরে গেলে তার আত্মার কি হয়? কোথায় চলে যায় সে আত্মা? সেকি এই ইথারেই থাকে? কেউ তার অভিজ্ঞতা থেকে আজো বলতে পারেনি মৃত্যুর পরে আত্মা আসলে কোথায় যায়। কিংবা মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব থাকে কতোটুকু ? সেই আত্মার কি কোনো রকম অনুভূতি আছে? যেহেতু এটি মৃত্যুর পরের অৰস্থা, তাই এর কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা কেউ লিখে যায় নাই।

 

ক্লাশে কিংবা টিউটোরিয়াল ক্লাশে আহমদ শরীফ স্যার কিংবা সেই সময়ের তরুণ শিক্ষক হূমায়ূন আজাদ স্যার সিলেবাসের বাইরে অনেক কথাই বলতেন। তাঁদের অনেক বক্তব্যেই চিত্তকে আলোড়িত করত, মনের সিংহ দুয়ার খুলে যেত বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী বক্তৃতা শুনে। তাঁদের অনেক কথাই কোনো গ্রন্থে হয়ত লিপিবদ্ধ হয়নি। কিন্তু তাদের সেইসব মত ও পথ অনুসরণ করতে ব্যাকুল হয়ে উঠত আমার তরুণ মন।

 

আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল দর্শন শাস্ত্র। এই সাবসিডিয়ারি ক্লাশেই একদিন পরিচয় হয় সংস্কৃত ও পালি বিভাগের ছাত্রী কীর্তিকা পোখরেলের সাথে। কীর্তিকা এসেছিল নেপাল থেকে স্কলারশিপ নিয়ে। হালকা বাদামি বর্ণের চেহারার এই মেয়েটির লাবণ্য ছিল গৌরীয়, চোখ ছিল কালো, আর চুল ছিল কৃষ্ণ বর্ণের। অসম্ভব মার্জিত মনের মেয়ে ছিল কীর্তিকা। তার মননে ছিল কার্ল মার্ক্স, লেলিন, আর মাও সেতুং এর দর্শন। ওর সাথে যখন কথা বলতাম, তখন কোথায় যেন একটা অদ্ভূত মনের মিল খুঁজে পেতাম। 'আমরা করব জয় একদিন ' এর মতো সত্যিই আমরা দু'জন একদিন ভালো বন্ধু হয়ে যাই। 

 

ভিসি স্যারের বাড়ির পাশ দিয়ে, রেইনট্রির ছায়াতল দিয়ে, নির্জনতায় হাঁটতে হাঁটতে দু'জন প্রায়ই চলে যেতাম ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরীতে। ওখানে যেয়ে পড়তাম ঐ সময়ের সারা জাগানো যত বিখ্যাত বই। কীর্তিকাকে পড়তে দেখতাম বোভোয়ার, জন এ্যান্ডারসনের মতো দার্শনিকদের বই। আবার বায়রন, শেলী, সেক্সপীয়ার এবং বোদলেয়ারের বইও পড়ত সে। আমরা দুইজনই নেশার মতো সেইসব বই পড়তাম আর আলোচনা করতাম। পড়তে পড়তে ক্লান্তি চলে আসলে কখনো উঠে এসে বসতাম বারান্দায়। আমাদের সামনে থাকতো সবুজ ঘাস। আমি কীর্তিকাকে মাঝে মাঝে ফান করে আবৃত্তি করে শোনাতাম -- 

 

" দূর থেকে দূরে – আরও দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!

আকাশের আড়ালে আকাশে

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস :

বাতাসের ওপারে বাতাস –

আকাশের ওপারে আকাশ।"

 

একদিন টিএসসি র ক্যাফেটেরিয়ায় বসে দুইজন লাঞ্চ করছিলাম। খেতে খেতে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিল আমাদের। তারপর দুজন চলে যাই পুলপারে। অনেকেই বসা ছিল সেখানে। আমরাও বসে থাকি বিকেল পর্যন্ত। কীর্তিকা বলছিল, মানুষের আত্মার কথা। বলছিল স্বর্গ আর নরকের কথা। কি এক মায়াবী চোখে বলছিল -- ' এই যে তুমি আমি বসে আছি, কথা বলছি, এইসবই আমাদের আত্মার কথা। আমি যদি তোমার বুকে কান পেতে রাখি, আমি তার শুনব মর্মরধ্বনি। সে ধ্বনি কান্নারও হতে পারে, আনন্দেরও হতে পারে। আবার তুমি আমার বুকে কান পেতে ধরো, তুমিও শুনতে পাবে এইরূপই কোনো শব্দ । '

 

কীর্তিকা আরো বলছিল -- 'জানো স্বর্গ নরক বলতে কিছু নেই। মানুষকে ভালোবাসো, আত্ম পরিজনদের প্রতি খেয়াল রাখো, অন্নহীনকে অন্ন দাও, চিকিৎসাহীনতায় যে মানুষগুলো ব্যথা বেদনায় আর্তনাদ করছে, তাদেরকে একটু চিকিৎসা দাও। দেখবে এখানেই স্বর্গ সুখ পাবে। আর যদি তুমি এসব না করো, দেখবে তোমার চারপাশটা নরকের মতো মনে হবে। '

 

কীর্তিকা বলছিল -'তোমার একটি হাত আমার হাতের উপর রাখো। আমাকে ধরে উঠাও। চলো দুইজন হাত ধরে এই পুলপারে হাঁটি। এখন পরিক্রমণের সময়। ক্লান্ত হবে না কখনো। আমাদের অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে।'

 

কীর্তিকা একবার গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে কাঠমান্ডু থেকে ঘুরে ঢাকা চলে আসে। আমি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হোস্টেলে ওর রুমে যেয়ে দেখা করি। ছোট্ট কেটলীতে ও নিজেই চা তৈরী করে। সাথে টোস্ট বিস্কুট। চা খেতে খেতে শুনছিলাম স্টেরিওতে বাজানো টেরি জ্যাকের গান। 'স্কিন্ভ আওয়ার হার্টস এ্যান্ড স্কিন্ড আওয়ার নিস' এবং 'সিজন ইন দ্য সান' এ্যালবামের গানগুলো শোনার ভিতরে ডিলান আর বিটলসের মাঝে গুনগুন করছিল কীর্তিকা। আমি বলছিলাম, 'তুমি ভারতীয় গণ সংগীত পছন্দ করো না?'

কীর্তিকা : করি। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকার গান আমার ভালো লাগে। হেমাঙ্গের আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগীত 'ইন্টারন্যাশনাল' ও রাশিয়ান সুরে তার গাওয়া 'ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার তুফান (গান) টি 'In the call of comrade Lenin' এর ভাবানুবাদ। এটি কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।'

কথায় কথায় কীর্তিকা বলছিল চারু মজুমদারের কথা।এই বিপ্লবী কম্যিউনিস্টের আদর্শ সে ধারণ করত। ওর বড়ো ভাই নেপালের পূর্বাঞ্চলে চারু মজুমদারের সশস্ত্র আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি এলাকায় সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্ব নেপালে ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করে । কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, নাগি রেড্ডি প্রমুখের সহযোগিতায় অত্র অঞ্চলে একটি কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন গঠিত হয়। কীর্তিকার ভাই এই কনসোলিডেশনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিল।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন কিসের যেনো ছুটি ছিল। কীর্তিকা আমাকে আগের দিনই বলে রেখেছিল, আমি যেন ওর সাথে দেখা করি। আমি কলাভবনের সামনের সিঁড়িতে বসে ছিলাম। কীর্তিকা আসে অনেকটা ক্যাজুয়াল ড্রেস পরেই। ও আমাকে বলছিল, আমি একটু গুরুদ্বুয়ারা নানক সাই এর মন্দিরের ভিতরে যাব। তুমিও চলো আমার সাথে। আমি বললাম - 'আমাকে তো ঢুকতে দেবে না। ' ও বলল - 'আমার সাথে চলো, ঢুকতে দেবে।'

কীর্তিকা কোনো ধর্মই অনুসরণ করত না। কিন্তু ও আজ এই শিখ মন্দিরে প্রার্থনা করল। আমিও ওর সাথে প্রার্থনায় মগ্ন ছিলাম।

 

মন্দির থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরী বারান্দায় যেয়ে বসি দু'জন। কড়ই গাছ থেকে অহেতুক মরা পাতা ঝরে পড়ছিল। আমি কীর্তিকাকে বলছিলাম - 'তোমার কি আজ মন খারাপ? '

কীর্তিকা : না। তুমি কি এরিক সিগালের 'লাভ স্টোরি' বইটি পড়েছ? '

আমি : না, পড়িনি।  

কীর্তিকা ওর ব্যাগ থেকে লাভ স্টোরি বইটি আমাকে দিয়ে বলে, 'তোমার জন্য এনেছি। পড়ে নিও।'

আমি : আমি গতরাতে পড়ছিলাম কার্ল সাগান। আজ তুমি দিলে 'লাভ স্টোরি'।

কীর্তিকা : আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম কাল রাতে। স্বপ্ন কেন আসে? যে স্বপ্ন কোনোদিন সত্য হবে না, সেই স্বপ্ন আমাকে দেখতে হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব বলে হিমালয়ের পাদদেশে টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছি তুমি আর আমি। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা আর দেখা হয় নাই। দূরে অন্ধকারে দেখতে পেয়েছিলাম একাকী দুটি নক্ষত্র। '

আমি : স্বপ্ন তো স্বপ্নই। এর জন্য মন খারাপ করতে হয় না।

কীর্তিকা : আমাকে সিগারেট খেতে হবে।

আমি : খাও। তেমন কেউ আজ এখানে নেই।

 

বেশ কিছু দিন আমি কীর্তিকার সাথে দেখা করতে পারি নাই। আমারও ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল, ওরও চলছিল। পরীক্ষা শেষ হলে আমি হোস্টেলে ওর সাথে দেখা করতে যাই। দেখলাম, কীর্তিকা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। খুব মায়া হলো ওকে দেখে। ওর মনটা ভালো করার জন্য বললাম -- 'চলো সিনেমা দেখে আসি। মধুমিতায় চলছে ডি সিকার 'টু ওমেন'। ছবিটি দেখলে তোমার ভালো লাগবে। ওয়ার ফিল্ম। যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইতালিতে ঘটে যাওয়া এক মর্মস্পর্শী ঘটনা যা মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাই নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বসেরা এ চলচ্চিত্র।' 

 

ছবিতে গীর্জার ভিতরে মা এবং তার এগারো বছরের মেয়ে দুইজনই নাৎসী সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। কীর্তিকা ছবিটি দেখছিল আর আমার কাধেঁ মাথা হেলান দিয়ে কাঁদছিল। ওর মন ভালো করে দেওয়ার পরিবর্তে মনটি আরো বেশি খারাপ করে দিয়েছিলাম। হল থেকে বেরিয়ে রিকশায় আসতে আসতে কীর্তিকা বলছিল,পরশু কাঠমান্ডু চলে যাব। আবার কবে আসব, জানিনা। নাও আর আসতে পারি। সার্টিফিকেট এ্যামবাসি থ্রো নিয়ে নিতে পারি। তুমি কাল একবার আমার হোস্টেলে চলে এসো।

 

রাতে আর ঘুম আসছিল না। শুয়ে শুয়ে কীর্তিকার শুকিয়ে যাওয়া মুখটির কথা মনে হচ্ছিল। বারবার শুধু এপাশ ওপাশ করছিলাম। রাতের শেষ প্রহরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি দুপুরের একটু আগেই কীর্তিকার রুমে চলে যাই। ওর রুমে বসতেই গুনি - স্টেরিওতে বাজছে, লুডভিগ ফান বেটোফেনের পিয়ানোর সুর।

কীর্তিকা বলছিল, এবার যেয়ে আমি কমুনিস্ট পার্টিতে পুরো দমে কাজ শুরু করে দেব। আমি সিন্দুলি, দুলাখা আর গুর্খা এরিয়াতে মেয়েদের সশস্ত্রভাবে সংগঠিত করবো। পার্টির পরবর্তী স্টেপ একটি জনযুদ্ধ। যা নেপালের রাজ শাসনকে কবর দেবে।

 

কীর্তিকা বলছিল -- 'আমার শরীরটা হঠাৎই কেমন যেন রোগাগ্রস্ত হয়ে গেল। দুর্গম পাহাড়ে পাহাড়ে কিভাবে কাজ করব? '

আমি : তুমি ওখানে যেয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবে। আর একটি কথা।

কীর্তিকা : কি কথা।

আমি : তোমার সাথে আমার আর কি দেখা হবে না?

কীর্তিকা : থাকব নিষিদ্ধ জীবনে। কি হয় বলতে পারি না। যদি জয়ী হই, যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে। আর যদি মরে যাই, তবে আর দেখা হবে না। 

 

আমি কীর্তিকার হাতটি ধরি, বলি -- 'এই হাতে কি একটি চুম্বন দিতে পারি? '

কীর্তিকা : দাও। তুমি এত মন খারাপ করছ কেন, পাগল ছেলে! আরে, আমি তো আমার আত্মা তোমার বুকের মাঝেই রেখে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলেও তোমার কাছে থাকবে, মরে গেলেও তোমার কাছে থাকবে। '

 

শুনেছি জনযুদ্ধে কীর্তিকা মারা গেছে। মানুষের আত্মা আসলে কি হয়? কীর্তিকা বলেছিল, ও মরে গেলেও নাকি ওর আত্মা আমার বুকের মাঝে থাকবে। হ্যাঁ, আমি আজো নিঃস্তব্ধ রাত্রি দুপুরে আমার বুকের মাঝে বেটো়ফোনের সুরের মতো কীর্তিকার আত্মার স্পন্দন ধ্বনি শুনতে পাই।
এমআইপি

নামাজের সময়সূচী

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
Masjid
ফজর ৪:৪১
জোহর ১২:০৭
আসর ৪:২৯
মাগরিব ৬:১৪
ইশা ৭:২৮
সূর্যোদয় ৫:৫৬
সূর্যাস্ত ৬:১৪