Deshdeshantor24com: Bangla news portal

ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

রোড টু গৌরীপুর

রোড টু গৌরীপুর
গ্রাফিকস দেশ দেশান্তর ২৪.কম

অনেক ছোট বেলায় বাবার কাছ থেকেই শুনেছিলাম আমার এক ফুফুর কথা। সে ছিল বাবার সবচেয়ে ছোট বোন। তখন অবিভক্ত ভারতবর্ষ। বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম জেলাগুলোর সাথে আসামের সঙ্গে ছিল একটি নিবিড় সম্পর্ক। ব্যবসা বানিজ্য, বিয়ে সাদি এবং অন্যান্য যোগাযোগ ছিল প্রাত্যাহিক মেলবন্ধনের মতো। আমাদের বাড়ি উত্তরের জেলা বৃহত্তর পাবনাতে। আমার বাবা ব্যাবসায়িক কাজে আসামের ধুবরী এবং গোয়ালপাড়াতে যেতেন। ঐখানে কিছু আত্মীয় ছাড়াও বাবার পরিচিত জনেরাও ছিল।

আমার সেই ফুপুটির নাম ছিল নুরজাহান। সে নাকি বেশ সুন্দরী ছিল। বাবার ইচ্ছাতেই আমার এই ফুফুর ৰিয়ে হয় আসামের ধুবরীতে। নিতান্ত বালিকা বয়স ছিল তার। অসম্ভব সুন্দরী হওয়ার কারণে মাত্র তেরো চৌদ্দ বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে ছিল নাকি ওখানকার খান্দানী পরিবারের। প্রচুর জমি জিরাতের মালিক ছিল তারা।

এক শ্রাবণ বর্ষায় তিনটি বড় পানসী নৌকা করে ফুপুকে বিয়ে করার জন্য ধুবরী থেকে বরযাত্রীরা আসে। ঢাকঢোল, বাদ্য যন্ত্র আর কলের গান বাজিয়ে এসেছিল তারা। ব্রহ্মপুত্র আর যমুনা নদীর ভাটি বেয়ে ভরা বর্ষায় পানসীগুলো এসেছিল। আর বিয়ে করে উজান বেয়ে সে নৌকাগুলো চলে গিয়েছিল আবার ধুবরীতে। এই বিয়ে ছিল নাকি বিশাল আয়োজনের আর মহা ধুমধামের। এত সমারোহ, এত উৎসব আর এত আনন্দের মাঝে আমার সেই নুরজাহান ফুফু লাল শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন শ্বশুর বাড়ি চলে গিয়েছিল।

নূরজাহান ফুফুর সেই যে লাল শাড়ি পরে চলে গিয়েছিল তারপর আর ফিরে আসে নাই। ফুফুর শ্বশুর, শাশুড়ী, স্বামী ও বাড়ির লোকজন সবাই নাকি ফুফুকে খুব ভালোবাসতো ও আদর করতো। বিয়ের পরপরই ফুফু সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়। এবং সন্তান প্রসবকালীন সময়ে তিনি ওখানে মারা যান। একটি মেয়ে নাকি হয়েছিল। সে মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা বাবা আর তা বলতে পারে নাই। ঠিক সেই বছরেই অর্থাৎ সাতচল্লিশে ভারত বিভক্ত হয়ে যায়। তারপর আসামের ধুবরী আর ঐ পরিবারের সাথে বাবাদের সকল যোগাযোগ ও সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে।

বাবার মুখে এই ফুপুর কথা শুনে সেই কিশোর বয়সে আমার মনে রেখাপাত করেছিল। তাকে আমি কোনওদিন দেখি নাই, তার কোনও ছবি নাই, সে ছিল আমার জন্মেরও আগে। অথচ তার জন্য আমার প্রাণ কাঁদতো। কেন কাঁদতো, তাও জানিনা। আমি মনে মনে তার একটি মুখচ্ছবি অন্তরে গেঁথে রেখেছিলাম। বাবার মুখে ফুপুর কথা শোনার পর, আরো অনেক বছর চলে গেছে। ইতোমধ্যে বাবাও মারা যান। 

বাবার মুখ থেকে শোনা ফুপু বাড়ির দুই তিনটি তথ্য আমার মনে ছিল। আমার ফুপার নাম : আব্দুল রশিদ মন্ভল। গ্রামের নাম গৌরীপুর, ধুবরী, আসাম। প্রাণের এক অসম্ভব তাড়নায় আমার এই ফুপুর সমাধি খূঁজতে আমি এক ফাল্গুন মাসে চলে গিয়েছিলাম ধুবরীর সেই গৌরীপুরে।

ট্রেন নং ১৫৭৬৬, ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, শিলিগুড়ি টু ধুবরী। প্রত্যুষ ৬.৩০ মিনিটে শিলিগুড়ির নিউ জলপাইগুড়ি জংশন থেকে ট্রেনটি ধুবরীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে । আমি সামনে মুখি জানালার পাশে বসে আছি। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম জলপাইগুড়ির নয়নাভিরাম চা বাগান। ট্রেনটি যখন হাশিমারা স্টেশনে দাঁড়ায় তখন মনে পড়ছিল সমরেশ মজুমদারের কালবেলা কালপুরুষ উপন্যাস দুইটির কথা। পথে পথে আসছিলাম আর মিলাচ্ছিলাম উপন্যাসের সব চিত্রকল্পগুলি।

আলিপুর দুয়ার জংশনে ট্রেনটি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। আমি নেমে একটি রেস্টুরেন্টে ঘীএ ভাজা লুচি আর মহিষের দুধের ছানা দিয়ে নাস্তা করে নেই। ট্রেনটি কয়েকটি ছোট বড় নদী অতিক্রম করে, রাইডাক, কালিজানি তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে রাইডাক নদীটি আমাকে ভীষণরকম মুগ্ধ করেছিল।

কোচবিহার স্টেশন থেকে একজন ছাত্র উঠেছিল, ওর নাম শ্যামল রায়। ও পুন্ডিবারী আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। ওর কাছ থেকে আমি ধুবরী ও গৌরীপুর সম্পর্কে জেনে নেই। গৌরীপুরও একটি স্টেশন, ধুবরীর ঠিক আগের স্টেশনটাই হচ্ছে গৌরীপুর। ও আমাকে ধুবরীতেই নামবার ও থাকবার পরামর্শ দেয়। শ্যামলের সাথে আরো অনেক কথা হয়েছিল। ও তুফানগঞ্জ স্টেশনে নেমে যায়। অল্প কিছুক্ষণ সময়েই খুব ভাল লেগেছিল ছেলেটিকে।

ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন টি ধুবরীর খুব কাছাকাছি এসে যায়। শ্যামল বলেছিল, ঠিক ধুবরীর আগের স্টেশনটি গৌরীপুর। আমি স্টেশনটি দেখার জন্য জানালার কাছে বসে আছি। একসময় দেখলামও। আমার আত্মা কেমন যেন হিম হয়ে গেল। মুহূর্তেই চোখ মুখ বিষাদে ছেয়ে যায়। দ্রুতগামী ট্রেনটি এখানে থামলো না। ঝিকঝিক শব্দ করে ট্রেন ধুবরীর দিকে চলে গেল।

ধুবরী স্টেশনে নেমে ছোট এই শহরটির দিকে একবার তাকালাম। শহরটিকে কেমন যেন চেনা শহর মনে হলো। আজ থেকে অর্ধ শত বছর আগে এখানে আমার বাবার হাজারো পদচিহ্ন পড়েছিল। আমার নুরজাহান ফুপুরও অনেক পদচিহ্ন আছে এই শহরেই। ব্রহ্মপুত্র তীরে যোগমায়া ঘাটেই হয়তো বরযাত্রীর সেই পানসী নৌকাগুলো এসে ভীঁড়েছিল। এই ঘাট থেকেই হয়তো লাল শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্টেশনে এসেছিল ফুপু ।

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিক্সা ডাকলাম। বললাম - আমাকে এনএস রোডে মহামায়া হোটেলে নিয়ে যাও। তখন বিকাল হয়ে গেছে। আমি হোটেলে একটু রেস্ট নিয়ে আবারও শহরের ভিতর বের হই। একটি রিক্সা রিজার্ভ করে ঘুরতে থাকি শহরময়। চলে যাই ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। এই শহরের তিন দিকেই নদী। আমি একটি তীর থেকে ফিরে তাকালাম পশ্চিম পাড়ে। কে একজন বললো ঐপাড়েই বাংলদেশের রৌমারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যমুনা - ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে নৌকায় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর স্মরণার্থীরা এসেছিল এই ধুবরীতে।

পরের দিন সকাল বেলায় হোটেল থেকে চেক আউট নেই। ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে চলে আসি স্টেশনে। একটি লোকাল ডেমো ট্রেনে উঠে বসি। নামবো সামনের স্টেশন গৌরীপুর।

ট্রেনটি আস্তে আস্তে চলে আসে গৌরীপুরে। আমি কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে নেমে পড়ি প্লাটফর্মে। মৃদু পায়ে হাঁটতে থাকি প্লাটফর্মের উপর দিয়ে। আমি কোথায় যাবো, কাকে বলবো আমার ফুফুর কথা। কেউ চেনা নেই, কোনও আপন মানুষ নেই। স্টেশনেই একটি ছোট চা'র দোকানে যেয়ে বসি। দেখি একজন পৌঢ় লোক ওখানে বসে আছে। বয়স সত্তরউর্দ্ধো হবে। অমি ওনাকে নমস্কার দিয়ে বলি - 'কাকা আপনি কি এই গাঁওয়ের আব্দুল রশিদ মন্ডল নামে কাউকে চেনেন?' পৌঢ় লোকটি কিছুক্ষণ ঝিম ধরে রইলেন। একটু পর জিজ্ঞাসা করলেন - 'ওনার বাবার নাম কি?

আমি : বাবার নাম জানিনা। 

পৌঢ় : ওনার কোনও ছেলে মেয়ের নাম জানো কি?

আমি : একটি মেয়ে থাকতে পারে, তার নামও জানিনা।

পৌঢ় : তুমি কোথায় থেকে এসেছো?

আমি : বাংলাদেশ থেকে।

পৌঢ় : উনি তোমার কি হয়?

আমি : আমার ফুপা হয়। উনি বিয়ে করেছিলেন অনেক আগে, অবিভক্ত ভারত বর্ষের পূর্ব বাংলায়।

পৌঢ় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন -- ' চিনতে পারছি। উনিতো মারা গেছেন সে অনেক বছর আগে। '

আমি খুশিতে স্তব্ধ হয়ে যাই। পৌঢ়ের দুই হাত ধরে বলি -- 'কাকা, আপনি কি ওনার বাড়িটি কি আমাকে চিনিয়ে দিবেন? '

কাকা : আসো তুমি আমার সাথে।

গ্রামের মেঠো পথ ধরে আমি কাকার পিছনে পিছনে চলতে থাকি। প্রায় হা়ফ কিলোমিটার যাওয়ার পর দূরে নদী দেখা গেল। কাকাবাবু বলছিলেন, ঐটা ব্রহ্মপুত্র নদী। এক সময় অনেক দূরে ছিল, এখন কাছে চলে এসেছে। তবে এখন আর আগের মতো ভাঙ্গে না। আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা নদীর কাছেই চলে আসি। একটি টিনের বাড়ির কাছে এসে কাকাবাবু থামে। ফলের গাছ বেষ্টিত ছায়া ঢাকা খুবই ছিমছাম একটি বাড়ি। আমাকে বাড়ির বাইরে দাড় করিয়ে রেখে উনি ভিতরে চলে যান।

কিছুক্ষণ পর চল্লিশোর্ধ্ব একজন মহিলা কাকাবাবুর সাথে বাইরে চলে আসে। ওনাকে দেখার পরেই আমার ধমনির সকল রক্ত প্রবাহ থেমে গেল। জগতের সকল হাহাকার যেন সুখের আতিশয্যে ভরে উঠলো। বহু বছরের পূর্ব পুরুষদের রক্তের ঋণ পরিশোধ হওয়ার জন্য সমস্ত শরীর অসীম এক আবেগে চঞ্চল হয়ে উঠলো। কাকাবাবু বললেন - 'ইনি তোমার বোন, তোমার ফুপির মেয়ে।' আমি তাকে 'বুবু' বলে ডাক দেই। বুবু আমাকে তার বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন।

সেদিন আমার বোনটির বাড়িতেই ছিলাম। তার কাছেই জানতে পারি, ফুপুর মৃত্যুর পর ফুপা আর বিয়ে করে নাই। কিন্তু সেও বেশী দিন বাঁচে নাই। অকালেই সে মারা যায়। আমার এই বোনটির নাম, আলোজান। আমি আলো বুবু কে জিজ্ঞাসা করি, 'ফুপুর কবরটি কোথায়?'

আলো বুবু আমাকে বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে ভিটায় নিয়ে যায়। ওখানে বেশ কয়েকটি কবর দেখতে পাই। তার ভিতর দুইটি কবর আলাদা করে বাঁধানো। একটি ফুপু'র, আরেকটি ফুপার। ফুফু 'র কবরে শ্বেতপাথরের উপর লেখা আছে : মোছাম্মাৎ নুরজাহান খাতুন। মৃত্যু তারিখঃ ৮ই আগস্ট, ১৯৪৭ ইং। আমরা দুই ভাই বোন দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করি। মোনাজাতে অঝোর ধারায় দুইজনই কেঁদেছিলাম।

পরের দিন অপরাহ্নে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন ধুবরী থেকে ছেড়ে চলে আসে। ট্রেনটি আজকেও গৌরীপুর অতিক্রম করলো। আমি ফিরে তাকালাম আলো বুবুদের গ্রামের দিকে। পাশেই ব্রহ্মপুত্র চিরন্তন ধারায় বয়ে চলেছে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ হঠাৎই যেনো বেগ পেল এখানে। কিন্তু মনে হলো চাকা থেমে যাচ্ছে। এই মাটি এই দেশ অনেক দূরের দীর্ঘশ্বাস হয়ে পড়ে রইল। এই মাটির নীচে মিশে রয়েছে আমারই রক্ত ধারার অযুত বিন্দু, অশ্রু বিন্দু হয়ে। 

সমান্তরাল পথে ট্রেনটি তখন দ্রুত গতিতে চলে আসছিল আরো দূরের দিকে। পিছনে ফিরে তাকিয়ে থাকলাম, মনে হলো আলো বুবু এখনো কাঁদছে।

লেখক - কোয়েল তালুকদার

 
কেএ

নামাজের সময়সূচী

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Masjid
ফজর ৪:৪১
জোহর ১২:০৭
আসর ৪:২৯
মাগরিব ৬:১৪
ইশা ৭:২৮
সূর্যোদয় ৫:৫৬
সূর্যাস্ত ৬:১৪