Deshdeshantor24com: Bangla news portal

ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

ছোটগল্প

নীলাঞ্জনা

নীলাঞ্জনা
দেশদেশান্তর গ্রাফিক্স

ফরিদুল ইসলাম অফিস থেকে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন রাত্রি এগারোটা বেজে গেছে। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে সিড়ি বেয়ে তিনি দোতালায় উঠলেন। তালা খুলে ঘরে ঢুকেই তিনি দেখলেন, ঘর ভর্তি অন্ধকার।  

সকালবেলা ঘর থেকে বের হবার সময় মনের ভুলে জানালাটা সে খুলে রেখে গিয়েছিল। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের ল্যাম্প পোস্টের নিওন আলো এসে পড়েছে ঘরে। সেই আলো দেখে তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুমাবার জন্য তিনি শুয়ে থাকলেন না। এমনিতেই শুয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। 

একটুপর বিছানা থেকে উঠে কাপড় চেঞ্জ করে সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেল -- আকাশ ভরা আজ তারা নেই। চাঁদ নেই। সজল বাতাস নেই। শ্রাবণের মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ । ল্যাম্বপোস্টে জ্বলে থাকা বাল্বের চারপাশে উইপোকা ভিনভিন করছে।   

বাইরে থেকে আসার সময় তিনরাস্তার মোড়ে হেমায়েতের হোটেল থেকে দুটো তন্দুরি রুটি খেয়ে এসেছে। ইজি চেয়ারটা জানালার কাছে টেনে নিয়ে বসে তিনি একটি সিগারেট ধরালেন। সিগারেট টানতে টানতে ফরিদুল ইসলাম ভাবছিলেন জীবনের অনেক কথা।

 বাবা মরে গিয়েছিল একদম শিশু বয়সে। মা আর বিয়ে করেনি। ফরিদ' রা স্বচ্ছল ছিল না মোটেই। গ্রামের বাড়িতে কিছু জমিজমা ছিল। ফরিদের মা তাই থেকে কষ্ট করে ওকে লেখাপড়া করিয়ে বিএ পাশ করান।

ফরিদ একটি চাকুরি পায় রাবার মিলে। চাকুরি পাওয়ার পরপরই ফরিদের মা ফরিদকে বিয়ে করায়। মেয়ে তখন নবম শ্রেণিতে পড়ছিল। গ্রামের মেয়ে। দেখতে সুন্দরী। মাথা ভর্তি কালো চুল। গায়ের রং গৌরীয়। টানা টানা চোখ। মেয়েটি ফরিদের মায়ের ফুপাত ভাইয়ের মেয়ে। মায়ের পছন্দেই ঐ মেয়েটাকেই ফরিদ বউ করে ঘরে নিয়ে আসে।           

মেয়েটির নাম মোছাঃ নীলা বেগম। বিয়ে করার পর নীলা বেগমকে ফরিদ গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছেই রেখেছিল কিন্তু ছয়মাস না যেতেই ফরিদের মা অকস্মাৎ তিনদিনের জ্বরে ইন্তেকাল করেন। ফরিদ নিরুপায় হয়ে তার বালিকা বউকে টংগীতে তার কাছে নিয়ে আসে। টংগীর মধুমিতা রোডে দেড় রুমের একটি আধাপাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে বসবাস করতে থাকে।

ছোট সংসার। ফরিদ আর নীলা টংগী বাজারে যেয়ে ঘরের সব জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। একটি কাঠের খাট, একটা আলনা, চেয়ার টেবিল, লেপ তোশক, বালিশ, হাঁড়ি পাতিল সব। ঘর সাজাতে সাজাতে নীলা ফরিদকে বলেছিল -- 'ওগো তুমি একটা ছোট্ট বাড়ি করে দেবে না আমাকে? আমি মনের মতো করে আমার সেই বাড়িটি সাজাব।' ফরিদ বলেছিল -- তোমার বাড়ি হবে একদিন। তুমি তোমার মতো করে সে ঘর সাজিয়ে নিও।   

আর একদিন নীলা ফরিদকে বলে তুমি আমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে? আমি সিনেমা দেখব।

 আচ্ছা, দেখাতে নিয়ে যাব। 

ফরিদ আনারকলি সিনেমা হলে নীলাকে নিয়ে গিয়ে একদিন ' মনের মাঝে তুমি ' সিনেমাটি দেখিয়ে নিয়ে আসে।   

ছোট বাচ্চাদের মতো নীলা ফরিদের কাছে প্রায়ই বিভিন্ন আবদার করতেই থাকে।  

আর একদিন নীলা বলছিল 'আমি চিড়িয়াখানা দেখব। তুমি আমাকে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে নিয়ে আসো।' ফরিদ নীলাকে মিরপুরে নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানাও দেখিয়ে নিয়ে আসে। 

আর একদিন ফরিদ অফিস থেকে এসে দেখে নীলা কোনো রান্না করে নাই। ফরিদ নীলাকে বলে, রান্না করোনি যে। 

আমি আজ হোটেলে বসে খাব। আমাকে তুমি হোটেলে নিয়ে যাও। 

কী করবে ফরিদ! অগত্যা নীলাকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ায়ে নিয়ে আসে।

আর একদিন অফিস থেকে ফরিদ এসে দেখে নীলা সেজেগুজে শাড়ি পড়ে বসে আছে। ফরিদ বলে, তুমি সেজেছ যে ! 

আমার ইচ্ছা করছিল খুব সাজতে। তাই সেজে বসে আছি। কেমন লাগছে আমাকে? 

খুব ভালো লাগছে তোমাকে । একদম চাঁপা ফুলের মতো।      

আর একদিন অফিস থেকে ফরিদ এসে দেখে নীলা বাসায় নেই। নেই তো নেই কোথাও নেই। আশেপাশে বাসার সবাইকে জিজ্ঞাসা করে। তারাও কেউ কিছু বলতে পার না। গ্রামের বাড়িতে এবং আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজ খবর নেয় কোথাও নীলা যায় নাই।   

ফরিদ টংগী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে। তারা বিভিন্ন সূত্রে নীলাকে খোঁজাখুঁজি করে। পুলিশও কোনো হদিস করতে পারেনি নীলা কোথায় আছে। সে জীবিত আছে, না সে মরে গেছে।                

এরপর পাঁচ বছর চলে গেছে। নীলাকে কোথাওে খুঁজে পাওয়া যায়নি। নীলাকে হারিয়ে ফরিদ আর বিয়ে করেনি। চাকুরিতে সে মোটামুটি সুনাম করেছে। টংগীর মধুমিতা এলাকাতেই সে দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। ভাড়া বাড়িটি তিনি সামনের মাসের এক তারিখে ছেড়ে দিবে। গাজীপুরের শিমুলতলীতে জায়গা কিনে সে ছোট্ট একটি বাড়ি করেছে। বাড়ির নির্মাণ কাজ সবে শেষ হয়েছে। ফরিদ তার নতুন বাড়িতেই উঠবে।         

ফরিদের খুব ইচ্ছা করছে তার এই ছোট বাড়িটার একটি নাম দিতে। এই জগতে তার আর আপন কেউ নেই যে, তাদের কারোর নামে বাড়িটার নাম দেবে। সে রুমের ভিতর পায়চারি করছিল, আর ভাবছিল অনেক কথা। 

সে আবার জানালার কাছে যায়। আকাশ পানে চেয়ে দেখে, মেঘগুলো সরে গিয়েছে। একফালি চাঁদ দেখা দিয়েছে। মনে পড়ে নীলার কথা। নীলা বলেছিল -- 'ওগো তুমি একটা ছোট্ট বাড়ি করে দেবে না আমাকে? আমি মনের মতো করে আমার সেই বাড়িটি সাজাব।'  

মাসের পহেলা তারিখেই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে শিমুলতলীর নতুন বাড়িতে গিয়ে ফরিদ ওঠে। কাকতালীয় ভাবে এইদিনই তাদের বিয়ে বার্ষিকী ছিল। খুব বেশি জিনিসপত্র নাই। নীলা থাকতে যা কিছু কেনা হয়েছিল তাই-ই শুধু আছে একটি কাঠের খাট, একটা আলনা, চেয়ার টেবিল, লেপ তোশক, বালিশ, হাঁড়ি পাতিল।আর আছে একটি ট্রাঙ্ক, যার ভিতর নীলার এবং তার নিজের কাপড় চোপড় রয়েছে। নীলার হালকা কয়েকটি গহনা ও বিয়ের শাড়িটাও ট্রাঙ্কে আছে। নীলা যেখানেই যাক, যেভাবেই যাক, যাবার সময় সে এক কাপড় পরে চলে গিয়েছিল। কিছুই নেয় নাই। 

ফরিদ নতুন বাড়িতে যাওয়ার সময় টংগী থেকে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড লিখে নিয়ে যায়। সেই সাইনবোর্ডটি বাড়ির গেটের সামনে সে লাগিয়ে দেয়। সাইনবোর্ডে বাড়িটির নাম লেখা আছে 'নীলাঞ্জনাা '।   

'নীলাঞ্জনা' বাড়িটা খুব নিরিবিলি। আশেপাশে তেমন বাড়িঘর নেই, চারদিকে ছায়াবীথিতে ঘেরা। ফরিদ দুপুরে টংগীর এক হোটেল থেকে খেয়ে গিয়েছিল তারপর আর খায়নি। এখানে আশেপাশে কোনো খাবার হোটেলও নেই। নতুন বাড়িতে সে কোনো কিছু রান্নাও করে নাই। আসবাবপত্র এলোমেলো ভাবে মেঝেতে পড়ে আছে। সেগুলোও সে সাজায় নাই।  

একসময় সন্ধ্যা নামে নীলাঞ্জনাায়। রাত হলো। খাটটা জানালার পাশে পাতা ছিল। তোশকটা কোনো মতো বিছিয়ে ক্লান্ত ও অভুক্ত দেহ নিয়ে সে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘরে আলো জ্বালায়নি। জানালা দিয়ে নবমীর চাঁদের আলো বৃক্ষপল্লব ভেদ করে তার মুখের উপর এসে পড়ে। ঐ মধুবন্তী চাঁদ, এই জোছনা, ঝিরিঝিরি কোমল স্পর্শের এই হাওয়ায় ফরিদের চোখে ঘুম এসে যায়। এবং সে ঘুমিয়ে পড়ে। 

রাত তখন মধ্য প্রহর। কে যেন তাকে ডাকছে 'ওগো তুমি ওঠো, চোখ মেলো। দেখো চেয়ে তুমি! দেখো আমি এসেছি।' ফরিদের ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখতে পায় নীলা তার শরীর ছুঁয়ে বসে আছে তারই পাশে । কাঁদছে অঝোর ধারায়। তার পরনে বিয়ের দিনের শাড়ি, গলায় তার মায়ের দেওয়া মালাখানি, হাতে চুড়ি, কানে ঝুমকা দুল। পা দুটো আলতা মাখা। কপালে টিপ। নীলাকে আজ সেই বাসর রাতের মতো দেখতে লাগছে।     

নীলা বলছিল এমন করে কেউ নিজেকে কষ্টে রাখে। সময়মতো না খেয়ে শরীরটা কী করেছ! আমি নেই দেখে তুমি এমন পাগলামি করবে? কেউ কী চিরদিন থাকে নাকি? কেউ না কেউ আগে চলে যায়। ওঠো লক্ষীসোনা, আমি খাবার রান্না করেছি খেয়ে নাও।  

নীলা আরও বলে কী সুন্দর বাড়ি করেছ আমার জন্য। নাম দিয়েছ নীলাঞ্জনাা। আমি কী যে খুশি হয়েছি। তুমি তোমার কথা রেখেছ। ওঠো জান আমার। খেয়ে নাও। তুমি খেয়ে নিলেই ঐ বারান্দায় যেয়ে দুজন দাঁড়াব। আকাশে এখনও নবমীর চাঁদ জ্বলছে। আমরা দেখব নক্ষত্রের রাত আধো অন্ধকারে।  

ফরিদ নীলাকে বুকে জড়িয়ে বলে ' বলো, তুমি কখনও আমায় ছেড়ে তুমি আর চলে যাবে না।' 

আমাকে তুমি নেবে আবার ! তোমার নির্মল 

দেহ, কী করে তোমাকে ছুঁই ! আমি যে নরকে থাকি। নরকের শকুনরা আমার দেহের রক্ত মাংস চেটেপুটে খায়। আমাকে যদি চাও তবে এই অভাগীকে....     

'খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে;

যেখানে রব না আমি, রবে না মাধুরী এই,

রবে না হতাশা,

কুয়াশা রবে না আর- জনিত বাসনা নিজে বাসনার মতো ভালোবাসা

খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’

ফরিদের স্বপ্নটা ভেঙে যায়। নয়নের কোণে বিন্দু বিন্দু জলগুলো তখন অঝোর ধারায় ললাট পথগামি।    

 

লেখক - কোয়েল তালুকদার
এএজি