সাব রেজিস্ট্রি অফিসের নকলনবিশগণের চাকুরি জাতীয়করণ দাবি
ভূমি (Land) মানুষের আবেগের জায়গা । এই ভূমি থেকেই মানুষের সৃষ্টি, ভূমিতেই মানুষের বেড়ে উঠা, আর এই ভূমিতেই মানুষের শেষ ঠিকানা । মানুষ আয় করে ভূমিতে বিনিয়োগ করে, আবার বিপদে পড়লে এই ভূমিই বিক্রয় করে । এই ভূমির সাথে মিশে আছে মানুষের সুখ-দুঃখের কাহিনী মিশ্রিত অজস্র আবেগের গল্প। মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এই ভূমির স্বত্ব (Title) তৈরি হয় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ।
মূলদলিল (Original Deed) থেকে ভলিয়মে (Volume) অবিকল নকল করে থাকেন নকলনবিশগণ । সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এই নকলনবিশগণের মাধ্যমেই জনগণের ভূমির স্বত্বের স্থায়ীরেকর্ড (Permanent Record) সৃষ্টি হয় ।
স্থায়ী রেকর্ড প্রস্তুতকারী এই নকলনবিশগণ Work and Pay এর ভিত্তিতে এই কার্যালয়ে কাজ করে থাকেন । সাব-রেজিস্ট্রি অফিস একটি সরকারি কার্যালয় । এই সরকারি কার্যালয়ে জনগণের ভূমির স্বত্বের স্থায়ী রেকর্ড তৈরি হচ্ছে বে-সরকারি লোকজনের মাধ্যমে । ভূমির স্বত্বের মতো গূরুত্বপূর্ণ রেকর্ড বে-সরকারি লোকজনের মাধ্যমে প্রস্তুত করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং যৌক্তিকতা বিবর্জিত । এখানেই নকলনবিশগণের চাকুরি জাতীয়করণের (Nationalisation) প্রধান যৌক্তিকতা নিহিত ।
একজন নকলনবিশ যদি দৈনিক মান (Standard) বজায় রেখে নিয়মিত কাজ করে থাকেন । তাহলে মাস শেষে তাঁর পারিশ্রমিক দাঁড়ায় ৭-১০ হাজার টাকা মাত্র । এখানেও রয়েছে শুভংকরের ফাকি। সময়মতো বালাম সরবরাহের অভাবে বছরের অনেক সময়ই তাদের কোনো কাজ থাকেনা। তাদের চাকুরি No-Work-No-Pay ভিত্তিতে হওয়ায়, এই সময়টিতে তারা কোনো পারিশ্রমিকও উত্তোলন করতে পারেন না। দ্রব্য মূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে উপর্যুক্ত অংকের টাকায় কিংবা No Work পিরিয়ডে একজন নকলনবিশের পক্ষে পরিবারসহ জীবনধারণ করা কতটা দূর্বিষহ, তা কেবল ভুক্তভোগীই ভালো বলতে পারবেন । এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এই সমস্যা তাঁদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধির মাধ্যমেও করা যেতে পারে । জাতীয়করণ করা কি প্রয়োজন? কিন্তু ভূমির সত্বের মতো সরকারি দলিল (Public Document) বে-সরকারি লোকজনের মাধ্যমে প্রস্তুত করা কতটা যৌক্তিক বলে আপনার মনে হয়?
এবার আসা যাক, নকলনবিশগণের চাকুরি জাতীয়করণ হলে সদাশয় সরকারের কিরূপ আর্থিক ক্ষতি হতে পারে । সারা দেশে জেলা রেজিস্ট্রার অফিস রয়েছে ৬১ টি (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন ব্যতীত) এবং সাব-রেজিস্ট্রি অফিস রয়েছে ৫০১ টি । সাব-রেজিস্ট্রি অফিস মানুষের ভূমির স্বত্বের দলিল নিবন্ধনের পাশাপাশি সরকারের পক্ষে রাজস্ব আদায় (Revenue Collection) করে থাকে । বিগত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সারা দেশের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসমূহে ৩১,২৫,৩৬১ (একত্রিশ লাখ পঁচিশ হাজার তিনশত একষট্টি) টি দলিল নিবন্ধনের জন্য গ্রহণ করা হয় । এসব দলিল নিবন্ধনের জন্য গ্রহণের সময় সরকারের রাজস্ব বাবদ আদায় করা হয় প্রায় ১৫ (পনেরো) হাজার কোটি টাকা । এনবিআরের পরে দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় হয় নিবন্ধন অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসমূহের মাধ্যমে । বিগত ১৫ বছরের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর সারা দেশের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসমূহে গড়ে প্রায় ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) লক্ষ দলিল নিবন্ধনের জন্য গৃহীত হয় ।
সরকারের রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি মূল দলিল থেকে ভলিয়মে নকলকরণের জন্য নকলনবিশগণের পারিশ্রমিক প্রদানের উদ্দেশ্যে দলিলের সেবাগ্রহীতার নিকট থেকে এন ও এনএন ফি (Fee) সংগ্রহ করা হয় । বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এন ও এনএন ফিস বাবদ আদায় করা হয়েছে ১৮৭ (একশত সাতাশি) কোটি টাকা প্রায় । এই সংগৃহীত টাকার মধ্যে এনএন অংশের ফিস ‘নকলনবিশগণের পারিশ্রমিক তহবিল’ শীর্ষক চলতি হিসাবে জমা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি অফিসে এই হিসাবের বর্তমান স্থিতি প্রায় ১ (এক) কোটি বা তদূর্ধ্ব টাকা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সারা দেশের রেজিস্ট্রি অফিসসমূহে প্রায় ১৬ (ষোলো) হাজার নকলনবিশ রয়েছে । এসব নকলনবিশগণকে সরকারী কর্মচারী হিসেবে আত্তীকরণ করা হলে তারা ১৮তম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন । এক্ষেত্রে বছরে তাঁদের জন্য সরকারের ব্যয় হবে ৩০৪ (তিনশত চার) কোটি টাকা প্রায় । প্রতি বছর এন, এনএন, জি ও জিজি ফিস থেকে আদায় হবে প্রায় ২০০ (দুইশত) কোটি বা তদূর্ধ্ব টাকা । বছরে ১৫ (পনেরো) হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানে সরকার যদি আর ১০৪ (একশত চার) কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইহাতে সদাশয় সরকারের খুব আর্থিক ক্ষতি হবেনা বলেই অনুমিত হয়। নকলনবিশগণও এদেশের জনগণের অংশ। তাদের কল্যাণ ও জীবন ধারণের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। সরকার আয় করে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করার জন্যই। অতিরিক্ত ১০৪ (একশত চার) কোটি টাকা বিনিয়োগে যদি ১৬ হাজার পরিবারের ভাগ্য বদল হয়, তবে এর চেয়ে বিকল্প জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ সদাশয় সরকারের আর কি হতে পারে?
এএজি