প্রভাতফেরি ফিরে আসুক একুশের প্রভাতে

‘প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে/ বাংলা আমার বচন/ আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।’ কবি আল মাহমুদের কবিতায় ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরীতে অংশ নেয়ার যে আবেদন প্রকাশ পেয়েছে, সে আবেদন যেন বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষের। ভোর বা প্রভাতে উদ্বোধনী গান গেয়ে সবাইকে জাগানোর নামই প্রভাতফেরি। ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে গান গেয়ে ভাষাশহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর যে যাত্রা, সেটিই আমাদের প্রভাতফেরি। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কাকডাকা ভোরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিল প্রভাতফেরীতে। সেই থেকে প্রভাতফেরির যাত্রা শুরু।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্বিচার গুলিবর্ষণের ঘটনায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পরের বছরেই চালু হয় এই প্রভাতফেরি। প্রভাতফেরি আমাদের নিয়ে যায় ভাষা শহীদদের স্মৃতির মিনারে। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো শহীদ দিবস পালিত হয়। এই দিবসটি পালন শুরুই হয় প্রভাতফেরি দিয়ে। সব ছাত্র সংগঠনের সিদ্ধান্তেই এটা হয়। শুরু থেকেই ভোরে প্রভাতফেরির মাধ্যমে অমর একুশে পালিত হয়। প্রথম প্রভাতফেরির গান ছিল ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে’। সুরটিতে ছিল করুণ অনুভূতির প্রকাশ। পরে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের লেখা গান, ‘ভুলবো না, ভুলবো না, ভুলবো না এ ফেব্রুয়ারি ভুলবো না’ গানে প্রতিবাদী বলিষ্ঠতার প্রকাশ ঘটে। পরে ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ রচিত হলে ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে এবং এরপর থেকে নিয়মিত গাওয়া শুরু হয়।
এ গান গলায় তুলে প্রত্যুষে মানুষ বের হয়ে আজিমপুরের গোরস্থানে যেত শহীদদের কবরে ফুল দিতে। সেখান থেকে যেত শহীদ মিনারে, ফুল দিত সেখানেও। দেশের অন্য জায়গায়ও প্রভাতফেরি বের হতো, মানুষ যেত স্থানীয় শহীদ মিনারে। পরবর্তীতে দেশের সব এলাকায়ই শহীদ মিনার তৈরি হয়।
স্বাধীনতার আগেও শহীদ দিবস ভোরে পালিত হতো। স্বাধীনতার পর সেটা মধ্যরাতে চলে আসে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুসারে প্রভাতফেরির চলে আসে মধ্যরাতে। ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক ও কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামালসহ অন্যান্যরা বলেন, ছোটবেলায় আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করতাম এবং তখন প্রভাতফেরি হতো ভোরবেলায়। খালি পায়ে ফুল হাতে একুশের গান গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে যাওয়ার কথা আমার মনে আছে। কিন্তু ঠিক কখন থেকে প্রভাতফেরিটা ভোর থেকে একুশের প্রথম প্রহরে, অর্থাৎ মধ্যরাতে চলে গেল তা ঠিক মনে নেই। প্রভাতফেরির এই সময় পরিবর্তন আমাদের কখনোই পছন্দ হয়নি এবং এতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কমে গেছে।
শহীদ দিবসের আয়োজনকে রাত ১২টায় নিয়ে যাওয়ায় বেশ কিছু নেপথ্যের কারণ থাকতে পারে। এতে করে রাষ্ট্রের সরকারি আমলা ও কর্তাব্যক্তিদের কিছুটা সুবিধা হয়। তারা নিজেদের মতো করে সুবিধাজনক সময়ে নিয়ম রক্ষার কর্মসূচি পালন করে চলে যেতে পারে। বিঘœ ঘটে সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। সংকুচিত হয়ে যায় তার স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বাভাবিকতা। গত অন্তত তিন দশক ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে অর্থাৎ রাত ১২টা ১ মিনিটে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে। শুরু থেকে প্রভাতফেরিতে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিলো। গভীর রাতে চলে আসায় সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে। ভাষাসংগ্রামী ও সংস্কৃতিজনরা এটা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমরা যেন ভুলেই গেছি, এটি আমাদের শহীদ দিবস। শহীদ দিবস এবং প্রভাতফেরি আমাদের জাতিসত্তার স্বাতন্ত্রের বিষয়। জাতিসত্তার গুরুত্বপূর্ণ এদিক ভুলে গিয়ে আমরা সরে গেছি আমাদের ইতিহাসের শেকড় থেকে অনেক দূরে।
ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারির আয়োজনেও ভিন্নতা এসেছে। এদিন নিতান্তই একটি উৎসব আর আয়োজনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানজট আর নানা সমস্যায় জর্জরিত নগর জীবনে কাকডাকা ভোরে উঠে প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়া বেশ পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার বটে। একুশে ফেব্রুয়ারির দিনব্যাপী উদযাপন এখনো হয়। আগের সময়ের চেয়ে অধিক আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরের সঙ্গেই হয়, কিন্তু আগের সেই প্রভাতফেরি আর নেই। মধ্যরাতে রাত ১২টা এক মিনিটে হলে তাকে তো আর প্রভাতফেরি বলা চলে না।
এখন প্রশ্ন হলো, ২১ ফেব্রুয়ারিকে হঠাৎ করে মধ্যরাতে নিয়ে যাওয়া হলো কেন? ব্যাপারটি নিয়ে অনেকেই আপত্তি করেছেন। বলেছেন, এটা হচ্ছে বিজাতীয় সংস্কৃতির আক্রমণ। কথাটা অনেকাংশে সত্য। ইংরেজি হিসেবে দিনের শুরু হয় মধ্যরাতে। ইউরোপীয়দের বিশেষ বিশেষ দিন বা নববর্ষ মধ্যরাতেই শুরু হয়। এর সাথে পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। আমাদের শহীদ দিবসের ওপর নির্দিষ্ট কোনো জাতি প্রভাব ফেলতে পারেনি, প্রভাব ফেলেছে অভিন্ন পুঁজিবাদী সংস্কৃতি। দরিদ্র বিশ^কে নিজের সাংস্কৃতিক বলয়ের ভেতর টেনে এনে প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
পুঁজিবাদের চর্চা আর আমলাতন্ত্রের নানা সংস্কার এড়িয়ে প্রভাতফেরিকে একুশের প্রভাতে ফিরিয়ে আনা খুব দুরূহ। একুশের প্রভাতফেরির চিত্র কল্পনা করলেই এখনো আমাদের চোখে ভাসে স্বৈরতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদের সে প্রটোকল, রণভেরি। ২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, সেখানে ফ্যাসিবাদের সকল চর্চা থেকে বেরিয়ে আসার ডাক এসেছে। প্রভাতফেরির সে মিছিল থেকে আমরা আবার সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের আবির্ভাব দেখতে পাবো। সে মিছিল আমাদের নিয়ে যাবে নতুন ভোরের দিকে। এক সুন্দর স্বদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
কলমে- নোমান বিন হারুন,
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কেএ