Deshdeshantor24com: Bangla news portal

ঢাকা বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব: ইতিহাস, সংকট ও সমাধানের পথ

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব: ইতিহাস, সংকট ও সমাধানের পথ

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের এক অকল্পনীয় সূচনা হয়েছিল। এই কোম্পানি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিল; ফলে এ অঞ্চলের লোকদের শিক্ষিত করার তেমন কোনো প্রয়োজন অনূভব করেনি। যতটুকু শিক্ষার প্রসার বা প্রচার করেছে, ইতিহাসের আলোকে বলা যায় তা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদেই করেছে। শিক্ষার প্রসারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্রহ না থাকলেও ব্রিটিশ হিতবাদী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের চাপ পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। বাংলায় সুপরিকল্পিত শিক্ষা সম্প্রসারের মূল দু'টি উদ্দেশ্য ছিল— এক, সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সমর্থনপুষ্ট একটি বিশেষ মধ্যবিত্ত অভিজাত শ্রেণী তৈরি করা এবং দুই, স্থানীয়দের মাঝে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটানো।

(১২০৪-১৭৫৭) এ অঞ্চলের একমাত্র অধিপতি ছিল মুসলিম শাসকরা, যারা জ্ঞানার্জনকে ইসলামী বিধান মোতাবেক পরকালীন পূণ্যের কাজ এবং মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মনে করতেন। ফলে মুসলিম শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই তারা জ্ঞানার্জনের প্রতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিলেন। এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ন্যায় তৎকালীনও তিন স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল— এক, প্রাথমিক শিক্ষা; দুই, মাধ্যমিক শিক্ষা; তিন, উচ্চ শিক্ষা। এই শিক্ষাব্যবস্থা মসজিদ ও মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা এবং হিন্দুদের জন্য ছিল পাঠশালা। এ শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মাঝে নৈতিকতা সঞ্চার করা এবং স্ব স্ব ধর্মে শিক্ষিত করে তোলা। ইতিহাসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী শাসনের দ্বারা এদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।

কোম্পানি ১৬৯৮ সালে সনদ আইনের মাধ্যমে খ্রিস্টান পাদ্রীদের দ্বারা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে বাংলায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা করে। এজন্য এ অঞ্চলের বড় বড় শহরে মিশনারীদের নেতৃত্বে মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, যেমন— ‘Society of Promoting Christian Knowledge’ এর আওতায় ১৭৩১ সালে প্রথম ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে তৎকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা দেওয়া এবং খ্রিস্টধর্মের প্রচার করা হতো। নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে তৎকালীন কোম্পানির শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ সালে কলকাতা মাদ্রাসা, উইলিয়াম জোনস ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি এবং জোনাথন ডানকান ১৭৯১ সালে বেনারসে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের পর শ্রমিকেরা মারাত্মকভাবে শিক্ষাহীনতায় ভুগছিলেন, যার ফলে তৈরি হয় সভ্যতার সংকট। জ্ঞানের প্রকৃত আলো না থাকায় ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজিত হয়ে অধিকারের সাবলীল কণ্ঠ ধারণ করা ছিল অলীক স্বপ্নের মতো। ফলে তাদেরকে শিক্ষিত করার জন্য কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, যেমন— Sunday School Union (১৮০৩), Royal Lancastrian Institution (১৮০৮) ইত্যাদি। এ সময় সংস্কারবাদী Samuel Whitbread ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষে (House of Commons) ৭-১৪ বছরের শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের জন্য স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব করেন (১৮০৭)। তবে তা উচ্চ কক্ষে বাদ পড়ে যায়। এক্ষেত্রে বলা যায়, সমসাময়িক অনেক ব্যক্তিই এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাদের সব প্রস্তাব বাতিল হলেও প্রস্তাবের প্রায় ২০ বছর পর Cort of Directors এই অঞ্চলের লোকদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার দায়িত্ব নেয় নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই— কীভাবে বাংলাদেশের শিক্ষাকে প্রগতিশীলতার মোড়কে আবদ্ধ করে অকার্যকর এক শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিণত করা হয়েছে। যার ফলে তৈরি হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকেও আমরা দেখি পাশ্চাত্যকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নানা বিতর্কিত বিষয়গুলো দিয়ে সমাজে তৈরি করা হচ্ছে মতানৈক্য এবং ইসলাম বিদ্বেষী শিক্ষার্থী সমাজ। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কেন উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী নয়; এর উত্তর কী হতে পারে? পাগলের জট-পাকানো চুলের মতো এই যে আমাদের জট পাকানো শিক্ষাব্যবস্থা, এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।

জাতি শিক্ষা-দীক্ষায় দুর্বল হলে একচ্ছত্র ক্ষমতালোভী ক্ষমতাসীনদের যে লাভ হয়, এটা ষোল আনা সত্য কথা। এটা বোঝার জন্য একজন রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিলাতে ১৯৮৮ সালে সংবিধিবদ্ধ জাতীয় কারিকুলাম চালু করা হয়। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সব শিক্ষার্থীর জন্য একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা, যাতে করে শিক্ষাকালীন সময়ে কোনো ধরনের বৈষম্য কিংবা অসামঞ্জস্যতা না থাকে। জাতীয় পাঠ্যক্রমটি শিক্ষার্থীদের মূল জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যা তাদের শিক্ষিত নাগরিক হওয়ার জন্য অপরিহার্য। এর লক্ষ্য হলো, কঠোরভাবে শিক্ষার উচ্চমানকে বাস্তবিক রূপ দান করা। বাস্তব দুনিয়া আর স্কুলে যা শেখানো হয় তার মধ্যে একটি যোগাযোগ স্থাপন করা। সর্বোপরি, এটা নিশ্চিত করা যে সমস্ত শিশুকে মূল বিষয়গুলির বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে।

শুধুমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থার আদলে শিক্ষাকে সাজাতে গেলে আমরা তামাশার বস্তুতে রূপান্তরিত হবো; হবো নব্য উপনিবেশবাদের নয়া পুতুল। দেশীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির যোগসাজশ না থাকলে শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের শিক্ষার আধুনিক মোড়কে নিজেদের সঁপে দিলে আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি কখনো জাগ্রত হবে না। শির উঁচু করে নিজের দেশকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে ব্যর্থ হবো। চাপানো কিছু সৃষ্টির আনন্দে জীবন দান করতে পারে না, ঠিক যেমন পারে না 'মনের মধ্যে ঘা' দিতে। ১৮৩৫ সালের মেকলের মিনিটের মতো কেরানি বানানোর কেরামতি দেখানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। আমদানি-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ও নীতি দিয়ে আমরা বেশিদূর এগোতে পারব না। নিজেদের ভূমি, মানুষ ও সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তি ও দাবিকে সামনে রেখেই সাজাতে হবে শিক্ষার রূপকল্প, যা প্রথমে নিজস্ব দেশজ বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকেও যাতে ক্রমান্বয়ে ধরে ফেলতে পারে। এজন্য নিজস্ব ভাষায় বিদ্যা দান, বই রচনা এবং এর পাঠ ও পঠন জরুরি। নিজস্ব ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের উৎকর্ষ হয় ফল্গুধারার মতো— তা মাথায় না রাখলে জাতি বেশি দূর এগোতে পারবে না। ১৮৭৪ সালে জার্মান দার্শনিক কান্ট 'এনলাইটেনমেন্ট' বা আলোকায়নের কথা বলেন। সেই সূত্র ধরে কিছু বলতে গেলে বলতে হবে, শিক্ষা নিজের আত্মাকে জাগায় পরাধীনতার শিকল ভাঙার গল্প বলে। নিজেদের উন্নত মানুষ, জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই সবার কল্যাণে শিক্ষার বিস্তার করতে হবে এবং টেকসই ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। তাহলে সফলতার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

 

লেখক: ইতাঙ্গীর খন্দকার  

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
টিএ

আরও পড়ুন