Deshdeshantor24com: Bangla news portal

ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

ছোটগল্প

মহাপ্রস্থানের পথে

মহাপ্রস্থানের পথে
গ্রাফিক্স : দেশদেশান্তর ২৪

একদিন সকালবেলা বাড়ির সদর দরজায় কেউ একজন নক করছিল। আমি নিজেই যেয়ে দরজা খুলে দেই। লোকটাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে চিনেছি। তিনি ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একজন সিনিয়র হলমেট।

ওনার নাম আবদুল গাফফার। বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলায়। উনি আমার তিন বছরের সিনিয়র ছিলেন।পড়তেন রাষ্ট্র বিজ্ঞানে। আমার রুম থেকে চার রুম পরেই ছিল ওনার রুম। কোরিডোর দিয়ে হাঁটার সময় তাকে প্রথম দেখি। দেখার মাঝেই কথা হয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা হয়।  

উনি আমার সিনিয়র হলেও ওনার সাথে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।  তবে ওনাকে বেশিদিন হলে পাইনি। মাস ছয়েক পরে উনি মাস্টার্স সমাপ্ত করে হল ছেড়ে চলে যান।

প্রায় ত্রিশ বছর পর ওনাকে আজ দেখলাম। মুখ ভর্তি দাড়ি।  চুলগুলো উসকোখুসকো, মোটেই পরিপাটি নয়। অর্ধেক চুল পেকে গেছে। কেমন যেন পাগল দার্শনিক টাইপের লাগছে। অনেক বছর পর  হঠাৎ আজ ওনাকে এইরূপ দেখে একটু বিস্মিতই হলাম। বললাম - গাফফার ভাই আপনি কেমন আছেন? আমার বাসা চিনলেন কীভাবে?

-- অনেক আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে , অনেক পথ ঘুরে,  চেনা অচেনা  কত মানুষকে জিজ্ঞাসা করে তোমার খোঁজ আমি  পেয়েছি। যখন জানতে পারলাম তুমি এখানে এই শহরে থাকো, তখনই চলে এলাম তোমার কাছে।

-- খুব খুশি হলাম গাফফার ভাই। তা ভাবী কেমন আছেন?

-- 'সে হয়তো খুব ভালো আছে। যেখানে সে চলে গেছে সেখানে তার ভালো থাকারই কথা।' উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন -- 'তোমার ভাবি পরপারে চলে গেছে। এই তো মাসতিনেক হয়ে গেল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই গাফফার ভাই তারই এ্ক সহপাঠিনীকে ভালোবাসতো। দেখেও ছিলাম তাকে সেই সময়ে। মেয়েটি একজন ভালো এ্যাথলেট ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হার্ডেল রেসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। একধরনের অদ্ভুত সৌন্দর্য ছিল তার ধ্রুপদী দেহ জুড়ে। একবার হলে এসেছিল সে। গাফফার ভাইয়ের রুমে আমাকে কয়েকটি তাসের জাদু শিখেয়েছিলেন তিনি । কী অমায়িক স্নেহশীলা মেয়ে ছিল সে। এখনও আমার ভিতর তার সেই ব্যবহার ও তার রূপ সৌন্দর্য ধারণ করে রেখেছি। তার মৃত্যুর কথা শুনে আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল।

আমি গাফফার ভাইকে বললাম,  এ কী দুঃখের কথা শোনালেন গাফফার ভাই। আপনি এমন হয়ে গেছেন কেন? এত ভেঙে পড়েছেন যে!

দেখলাম, গাফফার ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে। আমি বললাম, কী হয়েছিল ভাবীর? সে বললো -- হার্টে সমস্যা ছিল। বাইপাস অপারেশনও করা হয়েছিল। অপারেশনের পর আট বছর তেমন সমস্যা হয়নি। সর্বশেষ আবার এ্যাটাক করে। হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলাম। পঁচিশ দিন আইসিইউ তে ছিল। এক পর্যায়ে কোমায় চলে যায়।

বললাম, তারপর?

-- সেদিন আমি হাসপাতালে ছিলাম না। কোমা থাকাকালীন অবস্থায় হঠাৎ সে নাকি চোখ মেলে তাকিয়েছিল। কর্তব্যরত ডাক্তারকে ইশারায়  বলে মুখের মাস্ক সরিয়ে ফেলতে বলেছিল। ডাক্তার প্রথমে রাজি হয়নি। ও নাকি করুণভাবে অনুনয় করছিল বারবার। ডাক্তার মাস্ক খুলে ফেলে। সে কথা বলছিল বিড়বিড় করে -- সব কথা ছিল অস্পষ্ট। পাশে থেকে এক নার্স তার ঐ কথাগুলি রেকর্ড করেছিল।  এক মিনিট তেত্রিশ সেকেণ্ডের একটি ভয়েস রেকর্ড আমার কাছে আছে। কিন্তু তার বলে যাওয়া কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বললাম, তারপর ?

-- ঐ কথাগুলো বলেই সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল চিরতরে। তার আত্মা চলে যায় এক অপার্থিব জগতে। আইসিইউতে কোনও আপন কেউ ছিল না। আমিও ছিলাম না। ওর প্রাণ স্পন্দন থাকা তপ্ত কপালে আমি আমার হাতের স্পর্শ রাখতে পারিনি। দেখতে পারিনি বিদায়কালীন সময়ে ওর ঐ চেয়ে থাকা চোখ, চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু। কী বলতে চেয়েছিল সে, কী কথা? কিছুই শোনা হয়নি।

গাফফার ভাই একটি সিগারেট ধরালেন। আমি স্তব্ধবাক হয়ে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন -- জানো রঞ্জন, আমার রাত কাটতে চায় না, আমার দিন ফুরায় না। কোথাও একদণ্ড ভালো লাগে না। উদাস হয়ে এমনই ঘুরি পথে পথে। নদীর কূলে  যেয়ে বসে থাকি। কখন বিকাল হয়, কখন সন্ধ্যা নামে, কোথায় কখন পাতা ঝরে পড়ে যায়। কোথায় কে গায় আনন্দ সঙ্গীত। কিছুই শোনা হয় না। সিগারেট খেতে ভালো লাগে। সিগারেট  পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে যায়।

তুমি হয়তো ভাবছ, আমি পাগল হয়ে গেছি। আসলে আমি পাগল হই নাই। তোমার ভাবী ত্রিশটি বছর আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিল। আমার আত্মার সাথে, আমার দেহের রক্তকণিকার সাথে, আমার সুখ দুঃখ বেদনার সাথে মিশেছিল। আমরা কখনোই বিচ্ছিন্ন হই নাই একদিনের জন্য।

আমি গাফফার ভাইকে বলি -- আপনার বাড়িতে আর কেউ নেই? আপনার ছেলেমেয়ে কিংবা আপন কোনও জন?

-- আমরা নিঃসন্তান ছিলাম। আমার মা অনেক বছর  আমাদের সাথেই ছিলেন। সেও নেই। কয়েক বছর আগে তিনি গত হয়েছেন।

-- আপনি এখন কোথায় থাকেন?

-- পলাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকুরি পেয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠানটি পলাশে অবস্থিত। ওখানে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে সামান্য জায়গা কিনে বাড়িও করেছি। ওখানেই থাকি। শীতলক্ষ্যার পাড়ে কত স্মৃতি আছে তোমার ভাবীকে নিয়ে। কত চাঁদের রাত্রিতে আমরা নদীর তীর ধরে হেঁটে বেড়িয়েছি। কত আকুল করা সন্ধ্যা নেমেছে নদীর জলের কলধ্বনিতে।

গাফফার ভাই আরও একটা সিগারেট ধরালেন।  কিছু সময় চুপ থেকে আমাকে ডাকলেন -  রঞ্জন।

-- জ্বী।

-- তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে তোমার কাছে যে জন্য এসেছি তাহলো -- তুমি তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলে। ভাষাতত্ব, ধ্বনিতত্ব পড়েছ। আমি তোমাকে তোমার ভাবীর মৃত্যুকালীন সময়ের কথাগুলোর 'ভয়েস রেকর্ড'' দেবো। তুমি সেই রেকর্ড শুনে তার কথাগুলো উদ্ধার করে আমাকে লিখে দেখাবে। তুমি রেকর্ডটা শুনলে বুঝতে পারবে, কিছু কিছু শব্দ অস্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু অর্থবহ কোনও বাক্য বোঝা যায় না।  তুমি বার বার বাজিয়ে সেই কথাগুলো উদ্ধার করবে।  কী পারবে না?

আমি গাফফার ভাইকে বললাম -- আপনি রেকর্ডটি আমাকে ফরোয়ার্ড করে দিয়ে যান। আমার অভিজ্ঞ একজন বন্ধু আছে। সে একজন ভাষা ও ধ্বনিতত্ববিদ। সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক। আমি ওকে নিয়ে চেষ্টা করব ভাবীর কথাগুলো উদ্ধার করতে।
আমি আমার সর্বমেধা দিয়ে চেষ্টা করব।

গাফফার ভাই আশ্বস্ত হলেন। এবং বললেন, তবে রেখে দাও। তুমি আমাকে অগ্রগতি জানাবে। আমি চলে আসব তোমার কাছে।

গাফফার ভাই সেদিনের মতো চলে গেলেন।

আমার সেই ভাষাতত্ত্ববিদ বন্ধুটিকে একদিন বাড়িতে  ডেকে নিয়ে আসি। আমরা দুজন মিলে  বারবার ভয়েস রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনি। প্রথম দিকে কিছু কথা রেকর্ডকৃত ছিল না।  হয়তো নার্স পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন না কথাগুলো রেকর্ড করতে। রেকর্ড করা   অনেক শব্দ বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। কিছু শব্দ অস্পষ্ট। অনেক শব্দ কিছুই বোঝা যায় না। আমরা শব্দ জোড়া দিয়ে দিয়ে এবং কাছাকাছি কিছু শব্দ প্রয়োগ করে অনেক ভেবেচিন্তে একটা অর্থবোধক পর্যায় দাঁড় করাই। এবং মোটামুটি শিয়র হই -- উনি হয়তো মৃত্যুর সময়ে এই কথাগুলেোই বলেছিলেন।

ভয়েস রেকর্ডের সবগুলো কথা ভাবী তার স্বামী গাফফার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। গাফফার ভাইকে খবর দেই চলে আসতে। উনি একদিন  চলে আসেন। কাগজে লেখা ভাবীর কথাগুলো তাকে পড়তে দেই --

'  আমি চোখ মেলেছি তোমাকে দেখতে। কিন্তু  তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না যে!  মহাপ্রস্থানের পথে আমি পা বাড়িয়ে। কত পথ পেরিয়ে কত দূরে চলে যাব একা। তোমাকেও একা রেখে যাচ্ছি...  আমার খুব দুশ্চিন্তা হবে -- আমাকে ছাড়া তুমি তো ভালো থাকো না। দিব্বি রইল, পাগলামি করবে না। ঠিক মতো খাবে ও ঘুমাবে....।'

'আমি যে পথ দিয়ে চলে যাচ্ছি, ঐ পথে আমার পায়ের চিহ্ন চিনে তুমি আমার কাছে চলে এসো। আমি যেখানে যাচ্ছি -- সেই দেশ আমি চিনি না। ওখানে কী শীতলক্ষ্যা নদী আছে? পলাশের আমাদের বাড়ির উঠোনের মতো ঐখানে কী উঠোন আছে? বাড়ির আঙিনার মতো আছে কী অলকানন্দার ঝাড়....?'

ঐখানে ঐ নদীর তীরে অলকানন্দার ছায়াতলে দাঁড়িয়ে  তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব। আমার ইহকাল কালের স্রোতে ভেসে গেল। পরকাল থাকল। তুুমি এসো পরকালেই। আমি জানি -- তুমি ঠিকই পথ চিনে আমার কাছে চলে আসতে পারবে। লক্ষ লক্ষ তারা আর জোনাকগুচ্ছ আলো দেখিয়ে দেবে তোমাকে। আর সেখানকার গন্ধবাতাস পথ চিনিয়ে তোমাকে আমার কাছে ঠিকই নিয়ে আসবে...।"
এএজি