Deshdeshantor24com: Bangla news portal

ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

কামলিকা

কামলিকা
গ্রাফিকস: দেশ দেশান্তর ২৪. কম

বহু বিস্মৃত বহু বছর আগের এই কাহিনী। কমলিকা নামে এক সন্ন্যাসিনী কবে মহেশখালী দ্বীপে এসে তপস্যায় বসেছিল, তা কেউ বলতে পারেনা। মৈনাক শিখরে আদিনাথ মন্দিরের কাছে দেবী দুর্গার মন্দিরের পাশেই সে থিতু হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে এই তপস্বিনী এসেছিল উজ্জ্বয়িনী থেকে। 

প্রতি বৎসর ফাল্গুনের শিব চতুর্দ্দশী তিথিতে মন্দির প্রাঙ্গণে পূজো-অর্চণা ও মেলা হয়। এসময় পূণ্য সঞ্চয় ও মনস্কামনা পূরণার্থে বিভিন্ন স্থান হতে আগত তীর্থ যাত্রীদের পদচারণায় মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে। মন্দিরে বিরল প্রজাতির একটি পারিজাত ফুলগাছ রয়েছে। ভক্তগণ প্রতিনিয়ত মনস্কামনা পূরণার্থে মানত করে গাছে সূতা বেঁধে রেখে যান এবং কামনা পূর্ণ হলে সূতা খুলে পূজা অর্পণ করেন।

এমনই ফাল্গুনের শুক্লা চতুর্দ্দশীতে এক নাগা সাধক এসেছিল মন্দিরে পূজা অর্চণা করতে। কী এক মনস্কামনা নিয়ে যখন সেই সাধক পারিজাত ফুল গাছে সুতা বাঁধতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই দেখা হয় কমলিকার সাথে। মুহূর্তেই যেন সাধকের হাত পা অবশ হয়ে গেল। তাঁর হাত থেকে সুতা মাটিতে পড়ে যায়। সে পুনরায় তা মাটি হতে তুলে পারিজাত গাছের দিকে এগুতে থাকে। দেখে সব পারিজাত ফুলগুলো ব্রহ্মকমল হয়ে গেছে। 

সাধক সুতা বেঁধেছিল ডালে। তবে পূর্ব মনস্কামনা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল তার। সুতা বাঁধতে বাঁধতে সে মনে মনে বলেছিল --- আমি কমলিকাকে চাই। মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণে পূণ্যার্থীদের ভীড়ে কমলিকাও দেখেছিল এই ভিনদেশী সাধককে। চোখ মিলেছিল সাধকের চোখে। সে দুই চোখ বুজে ফেলে। পুনরায় চোখ মেলে দেখতে পায় ---পারিজাত ফুলগুলো আজ বেশি রকম রক্তিম হয়ে আছে। সে অনুভব করে, তার শরীরের বহমান রক্ত কণিকাগুলো ঐ রকমই লাল হয়ে উঠেছে। সে দ্রুত পা ফেলে ফিরে আসে আশ্রমে।

কমলিকা দুই দিন আশ্রম থেকে বের হলো না। সে বিছানায় শুয়ে কেবল অশ্রুপাত করেছে আর ভেবেছে --- যে প্রেম তাকে ঘর ছাড়া করেছে , যে প্রেমের গ্লানি ভুলে থাকার জন্য তাকে সন্ন্যাসিনী হতে হয়েছে। সেই রকম অভিশপ্ত কোনো মায়ার টানে নিজেকে আর জড়িয়ে ফেলতে চায় না।

এই দুই দিনে মেলা প্রাঙ্গণের কোলাহল অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। মনকে আর শরীরকে সে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আজ বড়ই ইচ্ছা হলো মন্দিরে সন্ধ‍্যা পূজা দেবার। কমলিকা আশ্রম থেকে বাহির হয়। সে পথ চলতে থাকে মন্দিরের দিকে। পাহাড়ে ওঠার সোপান গুলোতে সে পা ফেলতে পারছিল না। পা কেমন থেমে থেমে যাচ্ছিল। সে হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। হঠাৎ পিছন থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেল --- 'আমি কী আপনার হাতটি ধরব?'

এ যেন বহু বছরের পুরনো এক মহাজাগতিক কন্ঠস্বর। কোন্ দেবালয়ের দেবতা আজ এইখানে, এই সোপান উপরে। চোখ তুলে দেখতে পেল, সেই ভিনদেশি সাধক। যাকে সে দেখেছিল পারিজাত বৃক্ষ তলে। ততক্ষণে সাধক কমলিকার একটি হাত তার বাহুতে জড়িয়ে নিয়েছে।

অনেক রাত পর্যন্ত কমলিকা প্রণমিত ছিল দেব মূর্তির পদপাশে। নীরব অশ্রু বর্ষণে সে প্রার্থনা করেছিল পরমেশ্বরের কাছে --- 'আমাকে তুমি প্রেম দিও না। দিও না কোনো পাপ। কোনো অনাচার দিও না। জগতের যত আনন্দ কেড়ে নাও। যত মর্মরিত দুঃখ বেদনাও।'

কখন রাত্রি মধ্যপ্রহর হয়েছে জানতে পারে নাই। দেবালয় খালি হয়ে গিয়েছে। কমলিকা মন্দির থেকে বের হয়ে আসে। সে দেখতে পায়, সাধক ফটকে তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় --- আকাশ ভরা তারা আছে। নিশীথের নিঝুম মৌনতা আছে। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িঞ্চু চাঁদ তখনও অস্তমিত হয়নি। তখনও মান্দার ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। সাধকের আবারও সেই বিনীত কন্ঠস্বর --- 'তোমাকে আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে আসি।'

আবারও সেই পুরনো মায়ার টান। আবারও যেন পথ ভুল করে ফেলল আশ্রমের যাওয়ার পথ। তখন সাগরের মোহন শব্দ ভেসে আসছিল। আস্তে আস্তে চাঁদ ডুবে যাচ্ছিল পশ্চিমের মেঘের নীচে। মায়াবী এক আঁধার নেমে আসে মৈনাক পাহাড়ে। তপস্বিনী আর তপস্যায় রইল না। সন্ন্যাসিনীরও রূপ হারাল তার। কমলিকা হয়ে উঠল সম্পূর্ণ মানবী। আবারও সে একই ভুল করে ফেলল তার প্রথম যৌবনের ভুলটির মতো। এক অপার্থিব প্রেম প্রকাশিত হলো দেহ থেকে দেহান্তরে। একি পাপাচার, নাকি পূণ্যময়তা‌। 

ভোর হওয়ার আগেই সাধক কমলিকাকে আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে পারিজাত গাছটির কাছে ফিরে আসে। গাছে বেঁধে রাখা মনস্কামনার সুতাটি খুলে ফেলে। তারপর মন্দিরে যেয়ে পূজা দেয় দেবতার। অর্চণার সময় সে দৈববানী শুনতে পায় --- 'তুই পাপ করে এসেছিস। তোর পূজা আমি নেব না। তূই দূর হয়ে যা এখান থেকে।'

সাধক ক্লেশে আর গ্লানিতে --- প্রভাতের সূর্য কিরণ বিচ্ছূরণের আগেই মন্দির ত‍্যাগ করলেন। এরপর তাকে আর ঐ দ্বীপে দেখা যায়নি কখনও।

তারপর থেকে তপস্যায় আর মন নেই কমলিকার। পূজাও দিতে যায় না মন্দিরে। কায়ক্লেশ ছেয়ে আসতে থাকে জীবনে। সে বুঝতে পারে একটি ভ্রুণের প্রাণ স্পন্দন। সারা দ্বীপময় তার কলংক রটে গেল। সে আর মন্দিরে পূজা দিতে যেতে পারে না। এক সেবককে কমলিকা অনুরোধ করে --- ' তুমি আমাকে কিছু পারিজাত ফুল ছিঁড়ে এনে দেবে?' সেবক তাকে একগুচ্ছ ফুল এনে দেয়। 

সেদিন ছিল পূর্ণিমার চাঁদভাসি রাত। সে চলে যায় সাগর কূলে। চাঁদের আলোয় জলের ভিতর দেখতে পায় নিজের মুখ। আর দেখে প্রণয়ের সৃষ্টিতে তৈরি হওয়া একটি শিশুর মুখ। সে পারিজাতের পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে জলে ভাসাতে থাকে। এবং নিজে ডুবে যায় জলে।

আদিনাথের কোথাও কমলিকাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। দ্বীপের মানুষ সকালবেলা দেখতে পায় শুধু -- পারিজাতের ছেঁড়া পাঁপড়িগুলো সাগর জলে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে।

 
কেএ

আরও পড়ুন  

কথা
কথা