স্বপ্নের অভিযাত্রায় নতুন অধ্যায়

“এসো হে নবীন, বাজিয়ে সুর-লহরী উল্লাসিত নব বীণ। আজ সুর মিলিয়ে গাইব জয়যাত্রার গান, আনন্দে আহ্লাদিত নবীন প্রাণ।”
নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ করতে যেন এমনই উচ্চারণে মুখরিত হয় প্রবীণদের কণ্ঠ। উচ্চমাধ্যমিকের সফল সমাপ্তির পর জীবনের এক নতুন অধ্যায়—বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। এ পর্ব শুধু উচ্চশিক্ষার নয়, বরং আত্মগঠনের, জীবনের স্থায়ী ভিত্তি নির্মাণের এক অনন্য সূতিকাগার।
স্বভাবতই নবীনদের কাছে ক্যাম্পাস মানে উচ্ছ্বাস, রোমাঞ্চ আর অফুরন্ত স্বপ্নের পসরা। নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ, নতুন স্বপ্ন নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করে সম্ভাবনার পথ ধরে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের সেই স্বপ্ন, আশা আর এগিয়ে চলার গল্পগুলো তুলে ধরেছেন ক্যাম্পাস সাংবাদিক ও ফিচার লেখক ফাহিম হাসনাত।
জীবনের নতুন ঠিকানা: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ভার্সিটি লাইফ যেন জীবনের এক নতুন অধ্যায়, স্বপ্নময় আর কিছুটা ভয় মেশানো। স্কুল-কলেজের চেনা মুখগুলো পেছনে ফেলে নতুন শহর, নতুন ক্যাম্পাস আর নতুন মুখের ভিড়ে 'পাবলিকিয়ান' হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমি এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন ছাত্র।
২২ জুন, রবিবার, ছিল আমার ভার্সিটি জীবনের প্রথম দিন। খুব ভোরে ওরিয়েন্টেশনের উদ্দেশ্যে নোঙর বাসে চড়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছেই উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম—ফুল, উপহার আর দুপুরের খাবার দিয়ে আমাদের বরণ করে নেওয়া হয়। শিক্ষকদের মূল্যবান দিকনির্দেশনা আর বড় ভাই-আপুদের শুভকামনা আমাদের সাহস জুগিয়েছে। এরপর জেলার বড় ভাই ও আপুদের পক্ষ থেকে ফুল ও চিরকুট দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। দিন শেষে সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল নোঙর বাসে ফিরতি পথে, সবাই মিলে একসাথে গান গেয়ে বাড়ি ফেরা। নতুন সব অনুভূতি নিয়ে শুরু হলো এক নতুন যাত্রা, যেখানে দক্ষতা, মানবিকতা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে পথ চলার কামনা।
সজিব মিয়া
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ।
আমার নতুন নাম, নতুন সূচনা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার যাত্রা এক গর্বিত অভিজ্ঞতা, স্বপ্নে মিশ্র। পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় এটি প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের এক অনন্য মিলনস্থল। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা এখানে মিলেমিশে নতুন কিছু তৈরির অপার সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাব নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করে। শিক্ষকদের আন্তরিকতা, সহপাঠী ও বন্ধুদের চিন্তাধারা প্রতিনিয়ত আমাকে জ্ঞান অর্জনে উদ্বুদ্ধ করছে। সহশিক্ষা কার্যক্রম ও গ্রন্থাগার শিক্ষার্থীদের মানবিক শিক্ষায় সহায়ক। এখানকার শিক্ষার্থীরা নম্র চিন্তার মুক্তি ও যৌক্তিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতি সবসময় সচেতন এবং মানুষের কল্যাণ চেতনায় অঙ্গীকারবদ্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলো হল না থাকা। তবে এর ভালো দিক হলো, হল না থাকার কারণে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগ সহজ ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। একজনের বিপদে সবাই এগিয়ে আসে। এছাড়াও হল না থাকায় এখানের শিক্ষার্থীরা সংগ্রামী হয়; তাদের একটি বড় অংশ টিউশন পড়িয়ে নিজেদের হাত খরচ চালায়, যার ফলে ভবিষ্যৎ জীবনে সংগ্রাম ও পরিশ্রম করার চর্চা তাদের শিক্ষা জীবনেই হয়ে যায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুধু একজন শিক্ষার্থী নয়, বরং তারা একেকজন চিন্তাশীল, সচেতন নাগরিক হয়ে ওঠার পথে একজন সদস্য। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে নিজের ভেতরের সত্য ও সমাজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। এটি শুধু একটি উত্তির্ণের স্মারক নয়, এটি ভবিষ্যতের একটি গন্তব্য, যেখানে খুঁজে পাই আত্মবিশ্বাস আর আমার আগামী দিনের পথ।
জান্নাতুল মাওয়া স্মৃতি
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ।
স্বপ্ন, সাহস আর সম্ভাবনার পথে
যে ছেলেটা সেদিনও রাস্তা পার হতে বাবার আঙুল আঁকড়ে ধরত, আজ সে কলেজ পেরিয়ে পা রেখেছে ব্যস্ত ঢাকার বুকে—একা, কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ে ভরপুর। অপরিচিত শহর, অজানা মানুষ আর মনের কোণে লুকানো একরাশ ভয়—সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে এসেছে সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার আলোয় নিজেকে গড়তে।
এই প্রাঙ্গণ শুধু শিক্ষার নয়, এটি আত্মকথন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পবিত্র ক্ষেত্র। করিডোরের প্রতিটি ছায়া, কর্ণারের প্রতিটি মুখ যেন হাজারো গল্প বলে—স্বপ্ন দেখা, লড়াই করা, ভালোবাসা। 'জগন্নাথের ছাত্র' পরিচয়টি যখন নিজের কাঁধে এলো, তখনই মনে হলো—আমি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছি। এখন আমার স্বপ্ন কেবল নিজের জন্য নয়, সমাজ আর দেশের জন্যও। জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে পা দিয়ে আমি অনুভব করছি—পরিবর্তন সহজ নয়, কিন্তু সম্ভাবনা অসীম। আমার প্রতিটি দিন যেন নতুন করে গড়ে নিচ্ছে আমাকে—আরও পরিণত, আরও দায়িত্ববান আর আরও সচেতন একজন মানুষ হিসেবে। জগন্নাথ আমাকে দিয়েছে দিগন্ত ছোঁয়ার সাহস। এখন আমার পালা—নিজেকে প্রমাণ করার, এবং সবার জন্য কিছু করে যাওয়ার। হয়তো এই শুরুটা খুব বড় কিছু নয়, কিন্তু এই ছোট শুরু থেকেই একদিন রচিত হবে আমার বড় গল্প। সেই গল্পে থাকবে সংগ্রাম, স্বপ্ন, ভালোবাসা আর সাফল্য।
মাহদি নূর তামিম
শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স বিভাগ।
নরসিংদীর সন্তান থেকে জবির আপনজন
অন্য সকল কলেজ শিক্ষার্থীর মতো আমিও স্বপ্ন দেখতাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেই স্বপ্ন পূরণ হয় যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। জবিয়ান হিসেবে জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করি।
২২ জুন ২০২৫ — আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। সেদিন নবীনবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রথমবারের মতো জবির পরিবারে যুক্ত হই। সিনিয়রদের ফুলেল শুভেচ্ছা, শিক্ষকদের পরামর্শ আর সহপাঠীদের উচ্ছ্বাস আমাকে ভীষণ আনন্দিত করে। মনে হলো, আমি এক প্রাণের বন্ধনে আবদ্ধ একটি পরিবারের সদস্য।
এরপরই আসে আমাদের জেলার নরসিংদীর সিনিয়রদের বিশেষ অভিবাদন পর্ব। ফুল, কেক আর শুভকামনা বাণীতে গড়ে ওঠে মধুর স্মৃতি, যা আমাকে আরো আপন করে তোলে এই পরিবারে।
অল্প সময়েই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে আমার প্রিয় ক্যাম্পাস। পুরান ঢাকার এই ছোট ক্যাম্পাসেই খুঁজে পাই মুক্ত মঞ্চের আড্ডা, ক্যাফেটেরিয়া সঙ্গ, সিনিয়রদের ট্রিট আর শহীদ মিনারের টান। বৃষ্টিভেজা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কিংবা ক্যাম্পাসের অলিগলিতে হাঁটতে হাঁটতেই বুঝে যাই—আমি জবিয়ান, আর এ পরিচয়ে গরীয়ান হতে চাই সবসময়।
হাফসা বিনতে আমিন
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে গর্বের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে
২০০৫ সালের কয়েক দফা আন্দোলনের মাধ্যমে পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে কলেজ থেকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। মাত্র ৭ একর আয়তনের এই ছোট্ট ক্যাম্পাসে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। বাজেট সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক সাফল্য ধরে রেখেছে।
বিসিএসসহ সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে জবিয়ানদের অর্জন উল্লেখযোগ্য। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও প্রশংসনীয়। এসব সফলতা আমাদের বড় স্বপ্ন দেখতে ও তা বাস্তবায়নের সাহস যোগায়।
শুধু পড়াশোনাই নয়, জবিতে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেয় বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠন। ক্লাসরুম সংকট থাকলেও শিক্ষকরা তা কখনো বুঝতে দেন না। আন্তরিকতা ও দক্ষতায় তারা পাঠদান করে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের কখনো কঠোর শাসনে, কখনো স্নেহভরে তারা গড়ে তুলছেন ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব।
শিক্ষকদের উদ্যোগে নিয়মিত সেমিনার-ওয়ার্কশপের আয়োজন হয়, যেখানে দেশ-বিদেশের গুণীজনরা অংশগ্রহণ করেন। এতে শিক্ষার্থীরা পায় নতুন ধারণা, দিকনির্দেশনা।
সীমাবদ্ধতার মাঝেও জবিয়ানরা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতায় সাফল্য অর্জন করে আসছে, দেশের অগ্রগতিতে রাখছে অবদান। তাই অন্যদের চোখে যেভাবেই দেখা হোক, আমার কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ই আমার গর্ব—আমি গর্বিত একজন জবিয়ান।
মোঃ আলী হাসান
শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ।
ঐতিহ্যের গর্বে গড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়
পুরান ঢাকার গর্ব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণের এক জীবন্ত প্রতীক। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার, অগ্রগতির পথ এবং জ্ঞানের অনন্য ভুবন—যেখানে নবীন-প্রবীণের মধ্যে গড়ে ওঠে আন্তরিক সম্পর্কের বন্ধন।
প্রথম দিন কিছুটা দ্বিধা-সংকোচ নিয়ে যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পা রাখি, তখনই বুঝতে পারি—এখানে র্যাগিং নয়, বরং সিনিয়রদের আন্তরিকতা, স্নেহ আর সহযোগিতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সিনিয়ররা শুধু পরামর্শ দিয়েই থেমে থাকেন না, আমাদের আপন করে নেন, প্রতিটি ধাপে সহযোগিতা করেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ আমাদের পিতৃ-মাতৃসুলভ আচরণে শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না, বরং ব্যক্তিত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ গঠনের শিক্ষাও দেন, যা আমাদের মানসিক বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্র নয়, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। পুরান ঢাকার বুকে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক ক্যাম্পাসের আশেপাশের স্থাপত্য, গলি-ঘুঁজি আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য শিক্ষার্থীদের মাটির সাথে সম্পর্কিত থাকতে শেখায়।
এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং আমাদের স্বপ্ন বুননের কেন্দ্রবিন্দু, যার মর্যাদা অটুট রাখতে আমরা গর্বিত জবিয়ানরা সদা সচেষ্ট থাকব।
তাওহীদা সুলতানা
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
কেএ