বেগম বাহার
রাউজানে এক শেষ যতি চিহ্ন পড়া বিকালে বনের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। পথ চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থেমে যাই। ধুলোমাটির রাস্তার উপরে বনের ঝরা পাতা পড়ে আছে। আমি সেই মরা পাতার উপর দিয়ে হাঁটতে থাকি সামনের দিকে। অদূরে দেখি একটি মাজার। প্রবেশ মুখে লেখা আছে -- হযরত সৈয়দ চাঁদ শাহ এর মাজার শরীফ, কদলপুর, রাউজান, চট্টগ্রাম। সেখানে অনেক ফকিরি মানুষ, বাউল, কাঙাল সহ অনেক নারী পুরুষের উপস্থিতি দেখতে পাই।
মাজার প্রাঙ্গণে হাঁটতে থাকি। ঘুরতে থাকি। দেখতে থাকি। কত বিচিত্র মানুষ এখানে। ফকির, বাউল, পাগল, সন্ন্যাসসহ কত মানুষ। এত মানুষের ভিতর একজনকে দেখে আমার খুব ভাল লাগল। পরনে লাল রঙের পিরান। মাথায় লাল পাগড়ি বাঁধা। মুখে দাড়ি। গোঁফও আছে। চল্লিশের মত বয়স তার। দেখে মনে হলো, সে একজন গায়েন হবে।
আমি তাকে সালাম দেই। বলি, 'আমার খুব তেষ্টা পাইয়াছে। এখানে জল কোথায় পাওয়া যাইবে?'
লোকটি সালাম গ্রহণ করে বলে, 'তুমি আমার সহিত আইসো।'
সে আমাকে মাজারের পিছন দিকে নিয়ে যায়। দেখি, ওখানে বহু বছরের পুরনো একটি টিউবওয়েল। পাড় পাকা করা নেই। লোকটি বলল -- 'আমি চেপে দিতেছি। তুমি আঁজলা ভরে খাও।'
পানি খাওয়া শেষ হলে লোকটি বলে -- ' তুমি আমার সহিত চলো।'
আমি তাকে অনুসরণ করি। সে আমাকে মাজার থেকে বেশ দূরে একটি জারুল গাছের নীচে নিয়ে যায়। ঘাসের আচ্ছাদিত বড় মাটির ঢিবির উপর দুইজন বসি। লোকটি আমার নাম জিজ্ঞাসা করে। আমি আমার নাম বলি। তাকেও তার নাম জিজ্ঞাসা করি -- লোকটির নাম, 'মোহাম্মাদ আয়ুব আলী ফকির।'
আয়ুব আলী ফকির তার ঝোলনা ব্যাগ থেকে একটি পাতার তৈরি চুরুট ধরিয়ে টানতে টানতে বলে -- ' তুমি কী কাউকে মুর্শিদ বানাইতে এখানে আসিয়াছ?'
আমি বললাম -- জ্বী।
আমি ওনাকে বলি, 'আপনার মুর্শিদ কে?'
আয়ুব আলী আমার প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। দেখলাম, সে চুরুটে ঘন ঘন টান দিচ্ছে। আরো কিছু সময় নীরব থাকার পর সে বলল, ' তাঁর নাম -- সবুর আলী ফকির।
আমি বললাম, আমি এ নামে তো পীর দরবেশের নাম কখনও শুনি নাই।
---- সে অনেক কথা।
আমার বয়স তখন বারো বছর। শিশু কালে মা বাবা হারাই। ভাই বোন কেউ ছিল না। এমন কেউ ছিল না যে, তার জন্য ঘরে থাকতে হবে। তাই ঘর ছাড়লাম। পথে নেমে কত পথ যে ঘুরলাম। ঘুরতে ঘুরতে একবার সুনামগঞ্জে যেয়ে ঘেটুর দলে যোগ দেই। আমি দেখতে বেশ নাদুসনুদুস ও সুন্দর ছিলাম। ঘেটু দলের মালিক আমাকে খুব পছন্দ করত। ভালো বাসত। আদর করত। একবার এক ভরা বানে, চাঁদনী রাইতে সর্দার আমাকে একটি উদাম ডিঙি নৌকা করে হাওরের অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়।
খুব ভাল লাগছিল রাতের হাওর। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ। জলের উপর ভাসছিল চাঁদ। জোৎস্নার রোশনাইতে ভেসে গিয়েছিল বিজন নির্জন চারদিকে। হঠাৎ নৌকাটি মাঝ দরিয়ায় থেমে যায়। সর্দার সুন্দর একটি গান গেয়েছিল হাছন রাজার। খুব আশেকি গান। খুব দরদ দিয়ে গাইছিল। গাইতে গাইতে সে গানও এক সময় থেমে যায়।
আমি তো কোনও সুন্দর বালিকা ছিলাম না। সর্দার আমাকে সে রাতে বালিকা বলে ভ্রম করে, বলে -- 'তোকে আমি খুব ভালোআবাসি।' সর্দার আমার উপরে হামলে পড়ে। তার আচরণে আমি খুব কেঁদেছিলাম। আমার কান্নার শব্দ হাওরের শূন্য আকাশে মিলে গিয়েছিল। কী করব? আমি পরের দিন ঘেটু দল ছেড়ে পালিয়ে চলে আসি।
---- আমি বললাম, তারপর কোথায় আসলেন?
---- পথে পথে ঘুরতে থাকি। ঘুরতে ঘুরতে ফরিদপুরের রাজবাড়ী যাই। ওখানে একটি যাত্রার দলে যোগ দেই।
আমি বললাম, তা যাত্রার দলে এখন নেই কেন? এই ফকির বেশে মাজারে মাজারে ঘুরছেন?
--- আমি যাত্রার দলে ছয় বছর ছিলাম। প্রথম প্রথম বালক পাঠগুলো করতাম। আমি গানও গাইতাম যাত্রার দলে। আমাকে মালিক ও মালিকান খুব ভালো বাসত। আমি কোনো টাকা নিতাম না। টাকা নিয়ে আমি কী করব? আমার তো ঘর নেই। সংসার নেই।
--- তো, ভালই তো ছিলেন।
--- ভালো ছিলাম। আবার ভালো ছিলাম না। এবার আর মালিক আমাকে ভালো বাসলো না। এবার আমাকে ভালো বাসলো মালিকান। সে ছিল আনন্দময়ী সুলেখা। চল্লিশোর্ধ হয়েও সিরাজউদদৌলা পালায় আলেয়া চরিত্রে দারুন অভিনয় করত।
সেই বার এক ভরা বর্ষার সময়ে গৌরনদী থেকে যাত্রাপালা শেষ করে পুরো দল লঞ্চে করে গোয়ালন্দ আসছিলাম। আমরা সবাই ড্যেকে বসেছিলাম। রাত তখন অনেক। কেউ ঘুমাচ্ছিল। কেউ ঝিমুচ্ছিল। আমার চোখে ঘুম আসছিল না। আমি ড্যেক থেকে উপরে দোতালায় চলে আসি। দেখি, পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। ভরা বর্ষায় খোলা নদীর আকাশে চাঁদ ! কী যে ভাল লাগছিল।
রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম একাকী। দেখি, সুলেখা মালকিন এসে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রেলিং এর উপর আমার হাত ছিল, সেই হাতের উপর মালকিন তার হাত রাখে। বলে-- 'চলো, আমরা চুপিচুপি ভাগ্যকূল ঘাটে নেমে পড়ি। রাতের অন্ধকারে অজ্ঞাত কোথাও চলে যাই।'
---- তারপর কী দুইজনেই নেমে পড়েছিলেন সেই রাতে, সেই ঘাটে?
---- নেমেছিলাম, তবে দুইজন নয়। পালিয়ে আমি একা।
---- তারপর?
বহু ঘাট পেরিয়ে এইখানে এই মাজার প্রাঙ্গণে চলে আসি। এখাণেই পরিচয় হয় সবুর আলী ফকিরের সাথে। সে গান গাইত। মারফতি গান। আমি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করি। সে ছিল সংসার বৈরাগ্য এক মানুষ। মুখে মুখে গান বানাইত, মুখে মুখেই সুর দিত।
আমার এই মুর্শিদ আমাকে বলত, জীবনে কখনো সংসারী হবি না। আল্লাহ নবীকে স্মরণ করবি। গানের ভিতর আত্মার শান্তি খুঁজবি। আধ্যাত্ম জীবন শ্রেষ্ঠ জীবন। এই খানে যে সুখ পাইবি, সে সুখ ঘরে পাবি না। এই দেখ, আমার দিকে চেয়ে। সত্তর বছর পার করলাম। এখনো ঘর নেই।
---- তা তিনি কোথায়? তাঁর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি তাঁর মুরিদ হব। তাঁকে মুর্শিদ মানব। ওনার কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।
উনি নেই। আজ পাঁচ বছর ধরে সে নিরুদ্দেশ। আমাদের দলে কুলত্যাগিনী একজন ফকিরনী ছিল। নাম বেগম বাহার। সেও সবুর আলী ফকিরের মুরিদ ছিল। ওনার বয়স ষাট পেরিয়ে গিয়েছিল। তারপরও মলিন কাপড়ের নীচে অপূর্ব সুন্দর রূপ লুকানো ছিল। বহু ফকির তার আশিকী নিতে চেয়েছিল। এই বেগম বাহারের সাথে আমার মুর্শিদের আশিকী হয়। এ জন্য সে অনুতপ্ত ও ছিল।
--- দারুন তো! তারপর?
একদিন এক ফাল্গুনের চাঁদনি রাতে বেগম বাহার কে নিয়ে আমার মুর্শিদ নিরুদ্দেশ হয়ে চলে যায়। তারা কোথায় চলে গেছে? কোথায় আছে? মরে গেছে না বেঁচে আছে। কিছুই জানি না।
রোমাঞ্চময় কিছু গল্প কাহিনি শুনে অদ্ভুত কিছু অনুভূতি নিয়ে আয়ুব আলী ফকিরের কাছে থেকে সেদিন ফিরে এসেছিলাম। এই জীবনে আমার আর কাউকে মুর্শিদ বানানো হয় নাই। সংসারও ত্যাগ করিনি। একজন মায়াবতীকে নিয়ে ঘরেই আছি।
লেখা ~~~ কোয়েল তালুকদার
এএজি