লাবণ্য হোটেল

তখন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে পাবনা থেকে নগরবাড়ি হয়ে ঢাকা আসছিলাম। আমাদের বাসটি যখন নগরবাড়ি ঘাটে এসে থামে, দেখি, ফেরী নেই। ফেরী আসতে তখনও অনেক দেরি হবে।
আমি বাস থেকে নেমে নদীর কূল ধরে হাঁটতে থাকি। তখন ফেরী ঘাটে এত যানজট ছিল না। হালকা পাতলা বাস ট্রাক। লোক জনেরও এত সমাগম ছিল না। খুব ভালো লাগছিল নদীর কূল ধরে হাঁটতে। জায়গায় জায়গায় বিকট শব্দ করে পাড় ভেঙে পড়েছিল। যমুনার বুক ভরে অথৈ জল। তীব্র স্রোত ধেয়ে যাচ্ছিল গোয়ালন্দের দিকে। হয়ত পদ্মার জলের টানে এই স্রোতের ধেয়ে চলা। কী সুন্দর মূর্ছনা। কখনো দাঁড়িয়ে থাকি, কখনো চলতে চলতে কান পেতে শুনি নদীর জলের গুঞ্জরণ। কী সুন্দর শীতল হাওয়া। নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের মতো আমার মাথার চুল বাতাসে এলোমেলো করে উড়ছিল।
বেখেয়াল হয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হয় এবং থেমে যাই। ফিরে আসতে থাকি ঘাটের দিকে। ফেরার পথে দেখি, একটি ছোট টিনের চালার খাবার হোটেল। সামনে কোনো বেড়া নেই। ছোট্ট সাইনবোর্ড লাগানো আছে। নাম: লাবণ্য হোটেল, নগরবাড়ি ঘাট, পাবনা।
হোটৈলটি ঘাটের দিকে থেকে সবার শেষে। বেশ দূরে এবং নিরিবিলি। এই নদীর কূলে, একটি টিনের চালের খাবার দোকান। নাম কিনা লাবণ্য হোটেল? লাবণ্য নামটি আমার সবসময় প্রিয়। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা যতবার পড়েছি, ততবার আমি লাবণ্যের প্রেমে পড়েছি। আজও এই নামে প্রেমে পড়লাম। আমি ঢুকে যাই লাবণ্য হোটেলে।
ভিতরে একটি পুরনো কাঠের চেয়ারে ষাটোর্ধ্ব একটি লোক বসা আছে। সম্ভবত সেই মালিক। আর একজন এগারো বারো বছরের কর্মচারী। পিছনের দিকে পাট সোলার বেড়া দিয়ে আড়াল করা রান্নার ঘর। লোকটি বেশ রাশভারী প্রকৃতির মনে হলো। আমি ওনাকে বললাম -- চাচা চা হবে?
লোকটি বলল: চা অইবো না। তবে ব্যবস্থা কইরা দেয়া যাইব।
আমি বেঞ্চের উপর বসি। লোকটি বালকটিকে বলছিল : তর মায়েরে একটু ডাক দে।
বালক রান্না ঘরে চলে যায়। একটু পর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরের একজন মহিলা বের হয়। আটপৌরে শাড়ি পরা। মাথায় ঘোমটা আছে। গায়ের রং বাদামী। পরনের কাপড় পরিচ্ছন্ন। দেখতে অত সুন্দর না হলেও মোটামুটি সুন্দরী। মুখায়বে একজন মার্জিত রমণীর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
লোকটি ঐ মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলছিল : তুমি এই ছোয়ালডারে চা বানাইয়া খাওয়াতে পারবা?
--- পারবো।
আমি বললাম, না, চা'র দরকার নাই। আমি ভাত খাবো।
লোকটি মহিলাকে বললো: তয় তুমি ভিতরে যাও।
আমি বললাম: কী তরকারি হবে?
লোকটি: ইলিশ মাছের ডিম, ইলিশ মাছ, বড়ো ইচা মাছ ও বাঘার মাছ।
আমি মনে মনে ভাবলাম, সবগুলোই খাব। তবে ভাত কম খাব। পকেট তো গরমই আছে। বাবা তিন মাসের হোস্টেল খরচ দিয়েছে। মা আলাদা করে আরো টাকা দিয়েছে।
আমি ওনাকে বললাম, চাচা, আমি সবগুলোই খাব। একটু আস্তে আস্তে। প্রথম দেবেন ইলিশ মাছের ডিম।
লোকটি ছেলেটিকে বলল, এই খাবার লাগা। প্রথম ইলিশের ডিম দিবি।
তখন বেলা মাত্র বারোটা হবে। আর কোনো কাস্টমার নাই।
আমি লোকটিকে বলি: চাচা, এই হোটেলের নাম লাবণ্য হোটেল কেন দিলেন?
--- তোমার চাচীর নামে হোটেল। সেই মালিক। আমি খালি দেখভাল করি।
--- চাচীর নাম কী?
--- মোছাঃ লাবণ্য খাতুন।
--- এত সুন্দর নাম, কে রেখেছিল এই নাম?
--- সে অনেক কাহিনী। তুমি পোলাপান মানুষ। এত কিছু বুঝবা না।
--- একটু বলেন, আমি বুঝতে পারব।
আমি চাচার সাথে একটু খাতির করার চেষ্টা করি।ইলিশ মাছের ডিম খেতে খেতে বলি -- আমাকে ইলিশ মাছের একটি গাদা ও একটি পেটি দেন।
লোকটি বলছিল: তোমার চাচী দৌলতদিয়া থাইকা আমার সাথে পলাইয়া আইছিল। ওর আসল নাম আমি জানি না। তোমার চাচীও কখনো কয় নাই। ওখানকার সর্দারনী নাম দিয়াছিল লাবণ্য। সেই বার দূর্ভীক্ষের সময় ওকে নাকি পঞ্চাশ টাকায় নাগেশ্বরীর এক লোক পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিল। তখন সে নিতান্তই বালিকা ছিল।
তোমাকে একটু কইলাম, তুমি জানিলে কিছু অইব না। ফেরী আইলেই তুমি চইলা যাইবা। তুমি কাউকে বলবা না। তোমাকে দেইখা খুব ভদ্র মনে হইতেছে, তাই বলিলাম।
--- আপনার হোটৈলের রান্না খুব সুস্বাদু হয়েছে। তা চাচীই বুঝি রান্না করে?
--- তোমার চাচীই রান্না করে।
--- খুব ভালো রান্না করে চাচী। আমাকে এক পিস বাঘার মাছ দেন।
চাচা খুব খুশি হলেন। আমি বললাম, তা চাচী কে আপনি বিয়ে করলেন কেন? উনি মনে হয়, আপনাকে খুব ভালবাসে?
--- আমি এর আগে তিন বিয়া কইরাছিলাম। প্রথম জন খুব সুন্দরী ছিল, তিন বছর ঘর করার পর এক পানসি নৌকার মাঝির লগে ভাইগা যায়। দ্বিতীয় আবার বিয়া করি, সেও দুই বছর বাদে এক শাড়ি কাপড়ের ফেরিওয়ালার লগে পইলা যায়। তারপর আবার বিয়া করি এক চোখ কানা এক বিধবাকে। সেও এক বছর পর এক কামলার সাথে নিরুদ্দেশ হইয়া যায়। এমনি করে এক এক কইরা সবাই আমাকে ছাইড়া চইলা গেছে। তারপর আর বিয়া করি নাই। দৌলতদিয়াতে লাবণ্যের লগে আমার পরিচয় হয়। সেই থেইকা ওকে আমার ভালো লাগে। ও আমাকে ভালবাসে।
--- কী ভাবে ওনাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন? আর বিয়ে করলেন কখন?
---- সেও অনেক বড়ো কেচ্ছা। তোমার লগে আবার যদি কোনো দিন দেখা হয় তখন বলিব। শুধু এইটুকুই বলতাছি, আমরা লঞ্চে মির্জাগঞ্জ ইয়ার উদ্দিন খলিফার মাজারে যাইয়া মাজার ছুঁইয়া, ওনাকে সাক্ষী রাইখা বিবাহ কইরেছি। আমাদের কোনো হুজুর বিয়া পড়ায়নি। আমাদের কোনো কাবিননামা নাই।
--- কাবিন করেননি, হুজুর বিয়ে পড়ায়নি, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না?
--- কেন অসুবিধা হইব? সবই মনের ব্যাপার। কাবিন কইরা, হুজুর দিয়া বিয়া পড়াইয়া তিন বিয়া কইরাছিলাম। কোনো বিয়া টেকেনি। সবাই চইলা গেছে। এই যে, তোমার এই চাচীর কথা কইলাম, সে কোনো দিন আমারে ছাইড়া চইলা যাইব না। আমাদের ভালবাসা দুজন দুজনকে ধইরা রাইখছে।
--- এখানকার মানুষ সব জানে না?
--- না জানে না। সবাই জানে সে আমার বিয়া করা পরিবার।
ঘাটের অদূরে নদীতে দেখা গেল ফেরী আসছে। ভেঁপু বাজাচ্ছে। আমি হোটেলের বিল পরিশোধ করে বলি -- 'চাচা আমি আসি।' দেখি সেই মুহূর্তে লাবণ্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। আমাকে চা দিয়ে বলে -- 'তুমি চা খেতে চেয়েছিলে। এই নাও, খাও।'
লেখক - কোয়েল তালুকদার
এএজি