Deshdeshantor24com: Bangla news portal

ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

ছোটগল্প

অপু

অপু
দেশদেশান্তর গ্রাফিক্স

শেষ পর্যন্ত দুটো টিকিটই ম্যানেজ হলো। হঠাৎ করেই মায়ের তোড়জোড়ে অবাক হলো অপু । অথচ গত মাসে নিজে থেকে কদিনের ছুটিটা বাবার সাথে কাটাতে চাইলে মায়ের ঘোর আপত্তি দেখে দ্বিতীয়বার বলবার সাহস পায়নি অপু। আসলে অপুর মা শায়লা এখন এত বেশি ব্যস্ত সময় কাটান যে বাড়ির জোবেদা বুয়া,দারোয়ান নিয়ামত চাচা আর ড্রাইভার সলিম ভাই এর মত অপুও মেপে মেপে কথা বলে মায়ের সাথে। সেই পিচ্চিকালের আবদারগুলো এখন স্বপ্নের মত লাগে। শায়লা ঘরে ঢুকেই সেন্টার টেবিলের উপর টিকিট দুটো রেখে সোফাটায় বসলেন গা এলিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে। সামনে টিভিটা চললেও অপুর মনোযোগ নেই সেদিকে। শায়লা সরাসরি তাকান ওর দিকে,

----- অপু, আমিও কাল তোমার সাথে যাচ্ছি।

অপু স্ক্রীনে চোখ রেখেই বলে,

--- কদিন আগে তুমিইতো বললে সময় হয়নি এখনও। তবে আজ হঠাৎ.......

  মা জল টলমল চোখে ধরা গলায় বললেন, 

---- জীবনের সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হয় না বাবা। কিছু কিছু অপরিকল্পিত ঘটনার কাছে আমরা হেরে যাই।

এরপর নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিকতার মোড়কে গলার স্বর নামিয়ে বললেন,

----- খাবার টেবিলে এসো। ভোরেই ফ্লাইট। সকাল সকাল রওনা হতে হবে।

স্বল্পভাষী অপু কিছুটা অবাক হলেও কিছু বলার খুঁজে পেলো না। ওকে বাবার কাছে পাঠাতে হচ্ছে বলে মা কি খুব আপসেট? হতে পারে।

সেবার বাবার কাছে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই শায়লা একটুক্ষন চুপ থেকে ধীর কন্ঠে বুঝিয়ে দিলেন, ইচ্ছে হলেই সব কিছু করা যায় না। চুক্তি অনুযায়ী এতদিন যেভাবে চলে এসেছো, সেভাবেই চলবে। ক্যালেন্ডারের পাতাই জানান দেবে তুমি কখন বাবার কাছে যাবে।

অপু সেবার নিজেও অবাক হয়েছিল নিজের উপর। হুট করে সে কেনইবা এমন আবদার করে বসলো। এমনতো হয় নি এর আগে। সেই যে ছোট্ট শহরের ছায়া ঘেরা একতলা উঠোনঅলা বাড়িটা থেকে মা ওকে ঢাকায় নিয়ে এলেন আলো ঝলমল এই বাড়িটায়। আসবার আগে শুধু জেনেছিলো মা এখানকার অফিসটা থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় থাকবেন এখন থেকে। বাবা তাঁর নিজের অফিস নিয়ে ছোট শহরটাতেই থাকবেন।

বাবকে ছাড়া আসতে খুব খারাপ লাগলেও ঢাকায় এসে সাজানো গোছানো আকাশ ছোঁয়া এ্যাপার্টমেন্টের দশতলায় এসে প্রথম কদিন খুব আনন্দে হলো অপুর। তারপর ধীরে ধীরে কেমন যেন বন্দী মনে হতে লাগলো নিজেকে। তাদের আলো আঁধারী ঘেরা ছোট্ট বাড়িটায় রেখে আসা বাবার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগলো। বাবার লোমশ বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাতে ইচ্ছে করলো আগের মত।

মা বুঝালেন, অপু তুমি অনেক বড় হবার জন্য বড় শহরে এসেছো। কদিন পরে নতুন স্কুলে ভর্তি হবে। 

----- মা বড় হওয়া পর্যন্ত কি আমরা বাবার কাছে যাবো না? একেবারে বড় হয়ে গেলে বাবা যদি চিনতে না পারে?

মা কোন জবাব দেন নি তখন।

জবাবটা অপু নিজেই বুঝে নিয়েছিলো সময়ের সাথে সাথে। 

এত এত চকোলেট আর আইসক্রিমের বক্স নিয়ে পরদিনই হাজির হলেন আসিফ সাহেব। সংগে জোবেদা বুয়া। মাতো এখানে বদলি হয়ে অনেক বড় পদে চাকুরী করবেন এখন থেকে। সারাদিন ব্যস্ততা বড় অফিসের। কখনও কখনও বিদেশেও যেতে হবে। তাইতো জোবেদা বুয়া অপুর দেখভাল করবে, কোন অসুবিধা হবে না অপুর।

এই নতুন বাড়িটাতো আসিফ সাহেবেরই। উনি মায়ের অফিসের বড় বস। অপু কতবার দেখেছে, সেই ছোট্ট শহরটা থেকে মা প্রায়ই ঢাকার হেডঅফিসে আসতেন কনফারেন্সে।  

এখানে আসার পর জেনেছে সেই আসিফ সাহেবকেই মা বিয়ে করে বাবাকে একা রেখে চলে এসেছেন। 

আসিফ সাহেব তাই এই বাড়িটা মাকে দিয়েছেন। উনার আরও অনেক বাড়ি আছে। জোবেদা বুয়া বলেছে আর এক আলিশান বাড়িতে আসিফ সাহেবের স্ত্রী সন্তানদের কাছেই এতদিন সে ছিলো। ওখান থেকেই জোবেদাকে এখানে আনা হয়েছে পুরনো আর বিশ্বস্ত বলে।

বছরের পর বছর নতুন ক্লাশে ওঠার সাথে সাথে অপু অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে। নিজেকে একটু একটু করে বড়ও ভাবতে পারছে। বাবার কাছেও যায় বছরে দুবার। কি সব চুক্তি হয়েছে উকিলের মাধ্যমে। সময় হলে মা কদিন আগেই প্লেনের টিকিট কেটে অপুর ছোট্ট নীল সুটকেশটা গুছিয়ে দিতে বলেন জোবেদা বুয়াকে। নির্দিষ্ট সময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসেন ড্রাইভার সলিম। আগে থেকেই বাবাকে ফোন দিতে বলেন মা।

বাবা অনেকের মাঝে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকেন এয়ারপোর্টে হাসি হাসি মুখ নিয়ে। অপুর ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে যেন পথ ফুরোতেই চায় না। একসময় ঝাঁপিয়ে বুকের মাঝে হারিয়ে যায়।

প্রতিবারই একটা আতংক নিয়ে বাবার বাড়ি যায় অপু। 

বাবাও যদি মার মত আবার বিয়ে করেন। জোবেদা বুয়াই এ চিন্তাটা ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আজ হোক, কাল হোক বাবা বিয়ে করবেনই। সেটা নাকি হবে সৎ মা। আর সৎ মানে যে কি বিভীষিকা তাতো অপু গল্পের বই আর মুভিতে ঢের দেখেছে।

কিন্তু বাবার সাথে বাড়িতে ঢোকার পর যখন দেখে সেই শুন্য ঘর, নিরব চারপাশ তখন মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। 

এতগুলো বছরে যা হয় নি তাই হলো আজ। অপু পার্কিং এ এসে দাঁড়াতেই সলিম ভাই ডিগি খুলে অপু র সুটকেশটা রেখে গাড়ির দরজা মেলে ধরতেই মা ওঠে বসলেন। একইভাবে বিস্মিত হয়ে দেখলো অপু মা প্লেনেও ওর পাশটিতে ওর হাতটা ধরেই বসে রইলেন।

----- আমি কি কয়েকদিন থাকবো মা?

----- না বাবা, আমি তোমাকে নিয়েই ফিরবো। তোমাকে ওখানে নামিয়ে আমি শহরের অন্য প্রান্তেই থাকবো।

অতর্কিতে অপুর হাতে লোনা জলের ফোটা পড়লো মার চোখের।

মা কাঁদছে। কেন? তবে কি বাবা সৎ মা নিয়ে এসেছেন?

তাতে মায়ের কি? মাওতো......

অপু এয়ারপোর্ট থেকে যখন বেরুলো, এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবাকে দেখতে পেলো না ।ধীর স্হির কাঁচা পাকা চুলের শান্ত সৌম্য মুখাবয়বে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বাবা কোত্থাও দাঁড়িয়ে নেই।

----- অপু........উ উ উ...…

এই বুঝি প্রতিবারের মত বাবা দূর থেকে ডাকলেন।

মা যখন ও বাড়ির বড় গেটটায় অপুকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন অপু অবাক চোখে দেখলো, সব সময়ের নীরব বাড়িটায় অনেক লোকের সমাগম। গেট পেরুতেই ইতস্তত ছড়ানো অনেক অনেক আসন পাতা। নারী পুরুষ শিশুদের জটলা এখানে ওখানে। কিন্ত বাবা? বাবা কই?

কে একজন কাঁধে হাত দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেলো অপুকে সামনে।

সবার অপেক্ষাটা যে এতক্ষন অপুকে ঘিরেই ছিলো।

" অপু এসে পড়েছে" গুঞ্জনটাও সরব হলো।

ছোট্ট অপু, জীবনপথে অনভিজ্ঞ অপু একসময় দেখলো তার চিরদিনের শান্ত, স্নিগ্ধ ভালো মানুষ বাবাটা সেজে গুজে এক ঝাঁক লোকের সাথে চলেই গেলো। একটিবারও অপুকে দেখে উচ্ছস্বিত হয়ে বললো না, অপু এসেছিস?

অপুও ডাকলো না। অভিমানে গাল ফুলিয়ে বললো না একবারও, বাবা তোমাকে এমন সাজে বড্ড অচেনা লাগছে। 

স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠলো। কেউ কেউ অপুকে পাশে নিয়ে বিলাপ করতে লাগলো। শুভ্র সফেদ ময়ূরপংখিতে রওনা হয়ে গেলো অপুর বাবা, না ফেরার ঐ দেশে। অপুর ছোট্ট মন অব্যক্ত ব্যাথায় কেবলই তোলপাড় করে বলতে লাগলো সবার অগোচরে আপন মনে,

জোবেদা বুয়া যে বলে, নতুন কাপড় পরে তুমি নাকি একদিন আমার সৎ মা আনতে যাবে। 

কিন্ত এ তোমার কেমন নতুন পোশাক পরা বাবা। তুমি নাকি আর জাগবেই না। আর ফিরবেই না তোমার বাড়িটিতে। আমি তাহলে কার কাছে আসবো বাবা। আমাকে নিয়ে তোমার আর মার চুক্তির কাগজটারই বা কি হবে?

 

লেখিকা ~ ~ ফাহমিদা রিআ

 
এএজি

নামাজের সময়সূচী

মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
Masjid
ফজর ৪:৪১
জোহর ১২:০৯
আসর ৪:২৯
মাগরিব ৬:১৪
ইশা ৭:২৮
সূর্যোদয় ৫:৫৬
সূর্যাস্ত ৬:১৪

আরও পড়ুন