সহজে তৈরি করা যায় শীতের যেসব জনপ্রিয় পিঠা
পিঠা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ। শীতের আগমন ঘটলেই সবার মনে পরে যায় শীতের পিঠার কথা। পিঠা ছাড়া বাংলার শীত পরিপূর্ণ হয় না। কনকনে শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে পিঠা খাওয়া গ্রামের অতি পরিচিত দৃশ্য। শীতের পরিচিত এই অনুষঙ্গ পিঠার চল ইদানিং রাজধানীতেও দেখা যায়। পাড়ার মোড়ে মোড়ে নানা ধরণের পিঠার পসরা সাজিয়ে অস্থায়ী দোকান খুলে বসেন অনেকেই। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই সব পিঠার দোকানকে অনেক নোংরা মনে হলেও এসব দোকানে কিন্তু বিক্রি-বাট্রা মোটেও কম হয় না। ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়িসহ সকল বয়সের, সকল পেশার মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পরখ করেন ভাপা, চিতই পিঠার স্বাদ।
দুধ পিঠা
শীতকালীন পিঠার রাজা হলো দুধ পিঠা। এর স্বাদ তুলনাহীন। আমাদের বাড়িতে শীতের সিজনে মাঝে মাঝেই এই পিঠা বানানো হত। মনে পড়ে যেদিন পিঠা বানানোর কথা থাকত সেদিন মনের ভেতরে সবসময় আনন্দ কাজ করত। খেলাধুলার জন্য বাইরে গেলেও বাড়ি ফেরার একটা তীব্র তাড়া অনুভব করতাম। অবশেষে বাড়ি ফিরেই হাত-মুখ ধুয়ে সোজা পিঠা খেতে বসা। তবে দুধ পিঠা সবচেয়ে মজা লাগে শীতের সকালে। এত্ত স্বাদ! কি আর বলব। ঠান্ডায় দুধ সমেত পিঠাগুলো প্রায় জমে যেত। হাতও ঠান্ডায় জমে যাবার যোগার হত। তবু এর স্বাদ যে অমৃত! তাই ঠান্ডা ভুলে খেতে বসে যেতাম। খাওয়ার পরেই ঠকঠক করে গা কাঁপত; সাথে দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি। এরপর রোদ পোহানোর উদেশ্যে ভো দৌড়। সত্যিই সে এক মজার অভিজ্ঞতা।
গ্রামের একটা কমন ব্যাপার হলো ‘দাওয়াত খাওয়ানো বা খাওয়া’। যেদিন বাড়িতে পিঠা বানানো হত সেদিন বাড়ি লোকে গমগম করত। আমরা আত্বীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের পিঠা খাওয়ার দাওয়াত দিতাম। তাদের প্রায় সবাই অতি উতসাহ সহকারে পিঠা খেতে আসতেন। আমরা বাড়ির সবাই মিলে আনন্দের সাথে তাদের আপ্যায়ন করতাম। সবাই মিলে মজা করে পিঠা খাওয়া হত। আমরাও মাঝেই মাঝেই দাওয়াত পেতাম। সানন্দে হাজির হতাম পিঠার রস আস্বাদনে। আহা! বড়ই মধুর ছিল সেই সময়গুলো।
পুলি পিঠা বা কুশলি পিঠা
স্থানীয় ভাষায় আমরা এটাকে বলি ‘কুশলি’ পিঠা। এটি চালের গুড়া দিয়ে তৈরী করা হয়। সুন্দর ডিজাইন করে এটা তৈরী করা হত। কুশলি পিঠার আসল মজা এর ভেতরের সুস্বাদু নারকেলের মিশ্রণ। কুড়ানো নারকেল, খেজুর গুড় ও নানা পদের মশলা দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে পরিমাণ মত জ্বাল দিয়ে তৈরী করা হত এই মিশ্রণ। কুশলি পিঠা অনেকেই তেলে ভেজে খায়। আবার দুধ পিঠার সাথে একই পাত্রে ভিজিয়ে খাওয়া হয়। দুধে মিশ্রিত কুশলি পিঠার স্বাদ একেবারে অনন্য।
ভাপা পিঠা
অতি পরিচিত ও সুস্বাদু আরেকটি শীতকালীন পিঠা। ভাপা পিঠা মানেই গরম গরম খেতে হবে। ঠান্ডা ভাপা পিঠা আর পান্তা ভাত একই জিনিষ। মনে পড়ে আমার আম্মা খুব সকালে উঠেই হাতের কাজ শেষ করে ভাপা পিঠা বানাতে শুরু করতেন। একটা-দুটা হলেই আমাদের ডাক পড়ত। আমরা দৌড়ে যেতাম চুলার ধারে। খুব মজা করে খেতাম। পিঠার ঠিক মাঝখানে থাকত পাটালী গুড় মিশ্রিত কুড়ানো নারকেল। সাথে থাকত খেজুরের গুড়। আহা! সে কি স্বাদ! আমাদের বাড়িতে বেশ বড় সাইজের পিঠা বানানো হত। কাজেই একটা খেলেই পেট ভরে যেত।
ভাপা পিঠা নিয়ে গ্রামে নানান মজার ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়। নতুন বা পুরাতন জামাই যাই হোক না কেন শ্যালিকা বা ভাবীরা প্রায়ই ভাপা পিঠার ভেতরে গুড়-নারকেলের বদলে মরিচের গুড়া দিয়ে জামাইকে আচ্ছামত হেনস্তা করতেন। এ নিয়ে একটা বিখ্যাত গানও আছে।
তেল পিঠা বা পুয়া পিঠা
এটিও বেশ মজার ও সুস্বাদু পিঠা। শীতকাল ছাড়াও অন্যান্য সময়েও এটার প্রচলন আছে। যাইহোক, এই পিঠা তৈরী করতে কিন্তু বিশেষ দক্ষতা থাকতে হয়। এটা না ফুললে তেমন মজা নেই। দেখতেও সুন্দর লাগে না। এটা গরম গরম যেমন মজা আবার শীতের সকালেও যথেস্ট ভাল লাগে। তবে এই পিঠায় তেলের ব্যবহার বেশী বলে কেউ কেউ এড়িয়ে চলেন। তবে আমি এটিও খুব পছন্দ করি।
ছৈ পিঠা ও মুঠো
আমার ধারণা এটি অনেকের কাছে অপরিচিত। বা এমনও হতে পারে এটি ভিন্ন নামে পরিচিত। আমাদের এলাকায় (পাবনা) যেটা বানানো হয় সেটার আকার অনেকটা সেমাইয়ের মত চিকন। চালের গুড়া দিয়ে তৈরী করা হয়। মনে পড়ে আমার আপারা আগের দিন রাতে এটা তৈরী করে রাখত। অনেক সময় লাগত এটি বানাতে। পরের দিন কড়া রোদে এগুলোকে উত্তমরুপে শুকানো হত; যাতে রান্নার সময় একটার সাথে অন্যটি লেগে না যায়। সন্ধ্যার দিকে রান্না হত। পাটালী গুড় মিশ্রিত দুধের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হত। এরপর ভাল করে জ্বাল দাও। কিছুক্ষণ পরে মজা করে খাও। অনেক সময় এর সাথে বেশ মোটা করে কিছু ছৈও মিশানো হত। এটাকে আমাদের এলাকায় ‘মুঠো’ বলা হয়। প্রথমে আঙ্গুল সমান একহারা একটা টুকরোকে ডান হাত দিয়ে মুঠি করে চাপ দিয়ে এটা তৈরী হত। যেজন্য এটাকে ‘মুঠো’ বলা হয়। এটিও গরম বা ঠান্ডা-দুটোই মজা।
আরো হরেক রকমের পিঠা এলাকাভেদে খাওয়া হয়। তবে আমার মনে হয় শীতকালীন পিঠা বলতে বেশীরভাগ মানুষই এইসব পিঠাকেই বোঝে।
টিএ